রাজধানীর ভাটারা এলাকায় মাদানী এভিনিউয়ের পাঁচখোলা খাল ভরাটের ‘ভুল’ ধামাচাপা দিতেই ফসলি জমিতে ব্রিজ নির্মাণের ‘মহাভুলের’ আয়োজন করেছে রাজউক। বৃহস্পতিবার বেরাইদ ও সাঁতারকূল মৌজাধীন জমির কয়েকশ মালিক বিতর্কিত ব্রিজ নির্মাণস্থলে বিক্ষোভ করেছেন। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট রাজউকের একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, পরিকল্পনা ও নির্মাণ ক্ষেত্রে প্রথম ভুলের খেসারত দেওয়ার আশঙ্কায় বারবার একই ভুলের অপকর্ম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, মূল খাল ভরাট করে সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ বন্ধের মতো পরিবেশ ধ্বংসের দায়-দায়িত্ব রাজউকের বর্তমান চেয়ারম্যান ও প্রধান প্রকৌশলী কেন নেবেন? ভুল মেনে নিয়ে পুনরায় খালের জায়গায় ব্রিজ নির্মাণের কোটি কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কে দেবে? প্রগতি সরণির নতুন বাজার থেকে পূর্বদিকে বালু নদী পর্যন্ত সম্প্রসারিত প্রধান সড়কটি মাদানী এভিনিউ হিসেবে পরিচিত। সম্প্রসারিত এ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের বেরাইদ-৩ নম্বর ব্রিজ নির্মাণ ক্ষেত্রে জবাবহীন এসব প্রশ্নেরই খেসারত দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেখানে নিরীহ মানুষের ফসলি জমি খনন করে কৃত্রিম খাল তৈরির কর্মকা চালাচ্ছে রাজউক। ফলে একদিকে বাপ-দাদার জায়গা-জমি তাদের হাতছাড়া হচ্ছে, অন্যদিকে গভীর খননের ফলে আশপাশের জমির মাটিও ধসে পড়তে শুরু করেছে।
মাদানী এভিনিউখ্যাত ১০০ ফুট রোডের পাঁচখোলা খালের ওপর ব্রিজ নির্মাণের নামে বারবার তুঘলকি কা কোনোভাবেই থামছে না। সেখানে স্রোতবাহী খালটির পানিপ্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ করে সড়ক নির্মিত হয়েছে, আবার অদূরেই ফসলি জমির ওপর নির্মাণ হয়েছে বেড়াইদের তিন নম্বর ব্রিজটি। এখন চলছে সম্প্রসারিত ব্রিজ নির্মাণের কাজও। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আবেদন-নিবেদন, স্থানীয় এমপির দফায় দফায় পাঠানো নির্দেশনাপত্র- কোনোকিছুই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যৌথ উদ্যোগে সরেজমিন যে সার্ভে সম্পন্ন করা হয়, নির্মাণ বাস্তবায়নে সে সার্ভে প্রতিবেদনকেও পাত্তা দিচ্ছে না রাজউক। বরং ভুল পরিকল্পনার নির্মাণকাজ তড়িঘড়ি শেষ করাটাই যেন উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। রাজউকের একতরফা চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বেরাইদ ও সাঁতারকূল মৌজাধীন জায়গা-জমির কয়েকশ মালিক নির্মাণস্থলে বিক্ষোভ করেন। স্থানীয় ৪২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আইয়ুব আনসার মিন্টু জানান, ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা চরম ধৈর্যের সঙ্গে বারবার রাজউকের হস্তক্ষেপ কামনা করেও পাত্তা পাচ্ছে না। এ এলাকাবাসীর ফসলি জমি, বসতভিটার ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ হয়েছে, ব্রিজ তৈরি হয়েছে। একই রাস্তা-ব্রিজের জন্য আবার তাদের ভিটাজমি গ্রাস করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা হাজী আবদুল ওয়াহাব ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, রাজউক প্রকাশ্য দিবালোকের সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করার বাহাদুরী দেখাচ্ছে। ৬০-৭০ ফুট চওড়া একটি খালকে মাটি ভরাট করে নিশ্চিহ্ন করে এখন আমাদের জায়গা-জমি কেটে কৃত্রিম খাল বানাচ্ছে। শত শত মানুষের আহাজারিকেও পাত্তা দিচ্ছে না রাজউক। এলাকার সেলিম মেম্বার, তৈয়ব আলী, মুর্শেদ মিয়া, আতাহার, ছোরহাব, মাজম আলী, ইদ্রিস মিয়াসহ অনেকেই জানান, বেড়াইদ ও সাঁতারকূল মৌজার সীমারেখা হিসেবে চিহ্নিত ছিল পাঁচখোলা খালটি। সারা বছর এ খালের পানিতেই আশপাশের ৮-১০টি গ্রামের বাসিন্দার ঘর-গেরস্থালি, ফসলি জমির পানির জোগান দেওয়া হতো। কিন্তু মাদানী এভিনিউয়ের ১০০ ফুট সড়ক নির্মাণকালে মাটি ভরাট করে খালটিকে মৃত বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন খালটির বুকে কোথাও একফোঁটা পানির দেখা মেলে না। বিক্ষুব্ধ বাসিন্দারা সম্প্রসারিত ব্রিজ নির্মাণের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করে খালটি আগে সচল করার দাবি জানান। তারা বলেন, খালের ওপর ব্রিজ বানানো হোক। তবে ফসলি জমি কেটে কৃত্রিম খাল বানিয়ে তার ওপর ব্রিজ বানানো চলবে না। গতকাল ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, বড় বড় রিগ মেশিনের সাহায্যে খনি খনন স্টাইলেই গভীর খাদ বানানো হচ্ছে। নতুনভাবে তৈরি করা খাদের ওপরই সম্প্রসারিত ব্রিজ নির্মাণের কর্মকা ও চলছে জোরেসোরে।
রাজউক সূত্র জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী, মাদানী এভিনিউ থেকে বালু নদী পর্যন্ত সড়ক ও ব্রিজ প্রশস্তকরণ এবং বালু নদী থেকে শীতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ (প্রথম পর্ব)’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এক হাজার ২৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্প্রসারিত এ প্রকল্পের আওতায় ১০০ ফুটের মাদানী এভিনিউয়ে তিন নম্বর ব্রিজ নির্মাণের ক্ষেত্রেই বাধে জটিলতা। সেখানে পাঁচখোলা খালের ওপর ব্রিজ নির্মাণের কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে খালটি ভরাট করে ১০০ ফুট প্রশস্ত রোড নির্মাণ সম্পন্ন হয়। পরবর্তী সময়ে খাল পেরিয়ে অন্তত দেড়শ গজ পূর্ব দিকের ফসলি জমিতে খাদ খনন করা হয় এবং এ খাদের ওপরেই চলছে ব্রিজ নির্মাণের কাজ।
এদিকে পাঁচখোলা খালের সঙ্গে ঘুরপথে খননকৃত খাদের সংযুক্তি ঘটানোর চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রেও ব্যক্তিমালিকানার ফসলি জমি অবৈধভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন। তারা জানান, সর্বশেষ সিটি জরিপ অনুযায়ী ৯০৮, ৯০৯ ও ৯২৪ নম্বর দাগেই তাদের পূর্ব পুরুষের জায়গা-জমি। যুগ যুগ ধরেই এসব জমি চাষাবাদের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। পাঁচখোলা খাল সংলগ্ন থাকায় এসব জমিতে প্রতি বছর দুই দফা ধান আবাদ এবং প্রচুর পরিমাণ সবজি উৎপন্ন হতো। কিন্তু রাজউকের সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় হঠাৎ করেই সেসব ফসলি জমিতে খাদ বানিয়ে তার ওপর ব্রিজ নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চালাতে থাকে। এ ব্যাপারে রাজউকে বারবার অভিযোগ জানিয়েও কোনো সুরাহা মিলছে না।
জানা যায়, ঢাকা-১১ আসনের এমপি এ কে এম রহমতুল্লাহ সরাসরি রাজউক চেয়ারম্যানকে পাঠানো ডিও লেটারের মাধ্যমে সরকারি পাঁচখোলা খালের ওপরই ব্রিজ নির্মাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ সংসদ সদস্যের পাঠনো চিঠির পরও পেরিয়ে গেছে চারটি বছর। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এলাকাবাসীর ন্যায্য দাবি-দাওয়া ও স্থানীয় এমপির তাগিদপূর্ণ নির্দেশনা মোটেও আমলে নেয়নি রাজউক। বরং তিন নম্বর ব্রিজটির সম্প্রসারিত নির্মাণকাজও ফসলি জমিতে শুরুর উদ্যোগ নেওয়ায় স্থানীয় এমপি পুনরায় চিঠির মাধ্যমে রাজউক চেয়ারম্যানকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। গত ২০ ফেব্রুয়ারি চিঠি পাঠানোর পরও ব্যক্তিমালিকানার জমিতেই ব্রিজ নির্মাণ কর্মকা চলতে থাকায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন বাসিন্দারা।