পর্যটনকেন্দ্র খুলে দেয়ার খবরে উচ্ছ্বসিত প্রকৃতিকন্যা খ্যাত সিলেটের পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। পর্যটকনির্ভর পেশার মানুষেরা ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। এখন শুধু পর্যটকদের জন্য অপেক্ষার পালা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে জল, পাহাড়-টিলা, নদী আর পাথর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছানাকান্দি, মিঠাপানির একমাত্র জলারবন রাতারগুল, কোম্পানিগঞ্জের সাদাপাথর এবং উৎমাছড়ায় সবুজের সমারোহ আরও বেড়েছে। ফলে পর্যটকদের চোখ জুড়িয়ে যাবে এখানে এসে। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জৈন্তাপুরের সারি নদী ও নগরের এমএজি ওসমানী শিশুপার্কও খুলছে আজ থেকে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা এই পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে ডাকা হয় ‘প্রকৃতিকন্যা’ নামেও। পর্যটনকেন্দ্র জাফলং সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে পিয়াইন নদ, যেখানে দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে আসছে স্বচ্ছ জলের ধারা। এই দৃশ্য উপভোগ করতে জাফলংয়ে আসেন পর্যটকরা। এছাড়া মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় ঘেঁষে স্বচ্ছ পানিতে সাদাপাথর ও পাহাড় থেকে নেমে আসা পানিতে জলকেলি খেলতে কোম্পানিগঞ্জের সাদাপাথর এলাকা পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
মিঠাপানির একমাত্র জলাবন রাতারগুলে পানিতে হিজল-করচ গাছের ভেসে থাকা ঝোপের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা নৌকা চড়তে অনেকেই আসেন এই জায়গাটিতে। এবার রাতারগুল দীঘদিন পর্যটকদের আনাগোনা না থাকায় নবরূপে পত্রপল্লবে সেজেছে।
সিলেটের পর্যটন বর্ষাকেন্দ্রিক হওয়ায় আশার আলো দেখছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পর্যটনকে বাঁচিয়ে রাখতে পর্যটকদেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। মাস্ক পরিধান ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে সবাইকে।
করোনার কারণে গত দুই বছরে ঈদসহ বিভিন্ন উপলক্ষে ঘরবন্দি সময় কেটেছে মানুষের। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে পরিবার নিয়ে বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ঘোরাঘুরিও ছিল সীমিত। সরকারি নির্দেশনার কারণে সারাদেশের মতো সিলেটেও বন্ধ ছিল পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্রগুলো। আর এতে ঘরবন্দি হয়ে পড়া মানুষজন হাঁপিয়ে ওঠেন।
প্রকৃতির কাছাকাছি কিংবা নদী-ঝর্ণার স্পর্শ নিতে দেশ-বিদেশের সাধারণ মানুষের অন্যতম পছন্দের স্থান সিলেট। কক্সবাজারের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যটকের সমাগম ঘটে পাহাড় টিলা, চা-বাগানে ঘেরা দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সিলেটে। সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার, চা বাগান, জাফলং, ভোলাগঞ্জ, রাতারগুল ঘুরতেই বেশি ভালোবাসেন পর্যটকরা।
পর্যটন সংশ্লিষ্টদের হিসাব মতে, স্বাভাবিক সময়ে বছরে প্রায় শতকোটি টাকার বেশি আর্থিক লেনদেন হয় পর্যটন খাতে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন সিলেটের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। তাই পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেয়ার খবরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন তারা।
তারা বলছেন, পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেয়ার পর পর্যটকদের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে এ খাত চাঙা হয়ে উঠবে।
এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ও সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি মো. তাহমিন আহমদ বলেন, করোনার কারণে পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ হওয়ায় সিলেটের অর্থনীতিতে বিশাল চাপ পড়েছে। পর্যটননির্ভর হোটেল-মোটেল, ট্যুরিস্টগাইডসহ সব ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছে। ১৯ আগস্ট থেকে পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেয়ায় এখাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছে।
হোটেল নির্ভানা ইন সিলেটের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, দীর্ঘদিনের অচলাবস্থার কারণে হোটেল-মোটেলের ব্যবসায়ীরা স্টাফদের বেতনভাতা পরিশোধ করে এ ব্যবসায় লোকসানি হয়ে আছেন। পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেয়ায় এখন এখাতের ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন।
ফারমিছ গার্ডেনের চেয়ারম্যান নারী উদ্যোক্তা ফারমিছ আক্তার বলেন, গত দুই বছর করোনার কারণে সিলেটের অনেক হোটেল ব্যবসায়ী আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। একইসঙ্গে ভ্রমণপ্রিয় মানুষেরা দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দি থাকায় মানুষের মনোজগতেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পর্যটনকেন্দ্র খুলে দেয়ায় পর্যটকদের মানসিক অবশাদ যেমন কমবে, তেমনি হোটেলগুলোতে পর্যটকদের আগমণ বাড়বে বলে আশা করছি। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যটকদের বরণে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।
পর্যটন শিল্প সমবায় সমিতি সিলেটের সভাপতি হুমায়ুন কবির লিটন বলেন, করোনার কারণে দেড় বছর ধরে পর্যটন খাতে অচলাবস্থা থাকায় সিলেটে প্রায় ২০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দীর্ঘসময় লাগবে।
পর্যটন পুলিশের জাফলং সাবজোনের পরিদর্শক মো. রতন শেখ বলেন, সরকারি নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে পর্যটকরা ঘোরাঘুরি করেন তা নিশ্চিতে আমরা কাজ করব। পাশাপাশি পর্যটকদের করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করতে টহলে থাকা পর্যটন পুলিশ কাজ করবে।