কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বস্তি

কুবি প্রতিনিধি।।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা কারণেই নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয়ে আসছে ছাত্রলীগ। ছাত্র হত্যা থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী লাঞ্ছনা, মারধর, হামলা, হল দখল, টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্যের ঘটনায় ছাত্রলীগ বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেও কমিটি বহালই ছিল। তবে এবার শেখ হাসিনা হলের ছাত্রলীগ সভাপতি কাজী ফাইজা মাহজাবিনের বিরুদ্ধে প্রভোস্টকে হুমকির অভিযোগ ওঠে। অবশেষে এরই জেরে কুবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হলো। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এ ঘোষণা সোমবার বিকেলে ক্যাম্পাসে পৌঁছলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। এর মধ্য দিয়ে কুবিতে ছাত্রলীগের বিতর্কিত সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজের টানা ১৬ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটতে যাচ্ছে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া, সাংগঠনিক নিষ্ক্রিয়তা, শৃঙ্খলাহীনতা ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থি কার্যকলাপে সম্পৃক্ত থাকার কারণে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলো।

কুবি উপাচার্য অধ্যাপক এএফএম আবদুল মঈন বলেন, কুবির প্রতিটি হল নিয়ম মেনে চলবে, এখানে হল প্রশাসন আছে। প্রভোস্টকে মাহজাবিনের হুমকির ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হবে।

শনিবার সন্ধ্যায় প্রভোস্ট সাহেদুর রহমানকে হুমকির পর ফাইজা মাহজাবিনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মাহজাবিন লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী। তিনি শেখ হাসিনা হলের ২১৮ নম্বর কক্ষে থাকেন, বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। গত অক্টোবরে তাঁকে শেখ হাসিনা হলের সভাপতি পদ দেন কুবি ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ। হলের সভাপতি হওয়ার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মাহজাবিন। একের পর এক অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে।

অভিযোগ রয়েছে, গত বছরের ৩১ জুলাই শেখ হাসিনা হল উদ্বোধনের পর থেকেই শিক্ষার্থীদের নিজের মতো সিট বরাদ্দ দিতে থাকেন তিনি। তাঁর পছন্দমতো সিটে না থাকলে হল ছাড়া করার হুমকিও দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া প্রায়ই তিনি হলের ভেতর চিৎকার- চেঁচামেচি করেন। নির্দিষ্ট সময় পর রুম থেকে বের হওয়া যাবে না, হল ফটকে কাউকে এগিয়ে দেওয়া যাবে না– এমন নানা অদ্ভুত নিয়ম তৈরি করেছেন তিনি। ভয়ে কেউ এসবের প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না।

গত নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে এক শিক্ষার্থীকে থাপ্পড় মারার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। গণরুম বানিয়ে সেখানে শিক্ষার্থীদের থাকতে বাধ্য করছেন তিনি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মাহজাবিন বলেন, এগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এদিকে প্রভোস্টের বিরুদ্ধে তিনি বিভিন্ন সময় অশালীন মন্তব্য এবং অপমানজনক আচরণ করার অভিযোগ জানিয়ে উপাচার্য বরাবর লিখিত আবেদন দিয়েছেন। তবে প্রভোস্ট তা অস্বীকার করেছেন। এ অভিযোগও খতিয়ে দেখা হবে বলে উপাচার্য জানিয়েছেন।

কে এই ইলিয়াস : এদিকে শিক্ষাজীবন শেষ হলেও গত ১৬ বছর ধরে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের একটি কক্ষ দখল করে আছেন কুবি ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি এক সন্তানের জনক ইলিয়াস। তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্রলীগের নেতারা নানা অভিযোগ করেছেন। এগুলোর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে হস্তক্ষেপ, টেন্ডারবাজি, শিক্ষকের ওপর হামলা, ছাত্রীদের নিপীড়ন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও সাংবাদিকদের মারধর রয়েছে। এ ছাড়া কুবিতে দলীয় কোন্দলে ২০১৬ সালে কাজী নজরুল ইসলাম হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ সাইফুল্লাহ হত্যার শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে বর্তমানে পিবিআই তদন্ত করছে। খালিদের মায়ের অভিযোগ, ইলিয়াসের ইন্ধনে তাঁর ছেলে নিহত হয়েছে।

জানা গেছে, কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বদরপুর গ্রামের ইলিয়াস কলেজজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি লালমাই পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। ২০০৭ সালে কুবির ভর্তি পরীক্ষায় পাস না করলেও পরে খেলোয়াড় কোটায় লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। তখন তিনি কুবি শাখা ছাত্রদলে যুক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইলিয়াস ছাত্রলীগে যোগ দেন। কুবি ক্যাম্পাসসহ কোটবাড়ী এলাকায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

২০১০ সালে কুবির এক শিক্ষার্থীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে তিনি সেই শিক্ষার্থীকে লাঞ্ছিত করেন। পরের বছর পরীক্ষায় প্রত্যাশিত নম্বর না দেওয়ার নিজ বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমানকে লাঞ্ছিত করেন ইলিয়াস। এ ঘটনা প্রমাণিত হলে এক বছরের জন্য তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।

তিনি বহিষ্কৃত হলেও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের ৩০০১ নম্বর কক্ষ ছাড়েননি। ২০১২ সালের ১৩ অক্টোবর ইলিয়াস তাঁর ক্যাডার বাহিনী নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলা এলাকার রিভারভিউ ফিলিং স্টেশনে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না পেয়ে ফিলিং স্টেশনে ভাঙচুর, হামলা ও গুলি চালান। এতে দু’জন গুলিবিদ্ধসহ আটজন আহত হন।

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে কুবি এলাকায় অস্ত্র নিয়ে দাঙ্গা বাধান ইলিয়াস। এ ঘটনায় সদর দক্ষিণ মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে। ২০১৫ সালের ২৪ এপ্রিল কুবি-সংলগ্ন শালবন বিহার এলাকায় অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগে তাঁকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, ২ রাউন্ড তাজা গুলি ও একটি মোটরসাইকেলসহ গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এ ঘটনায় অস্ত্র আইনে তাঁর বিরুদ্ধে র‍্যাব মামলা করে। এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তাঁকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে। এ মামলায় ইলিয়াস ছয় মাস জেলহাজতে ছিলেন।

তবে ২০১৭ সালের কুবি শাখা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটিতে তাঁকেই সভাপতি করা হয়।  তাঁর ভয়ে কুবির শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা সর্বদা তটস্থ থাকত।

গতকাল ইলিয়াস বলেন, তাঁর ছাত্রত্ব শেষ নয়, তিনি কুবিতে সান্ধ্যকালীন একটি কোর্সে অধ্যয়নরত, কোর্স প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির কারণে মাঝেমধ্যে হলে থাকতেন। এখন কমিটি বিলুপ্ত, তাই আর থাকবেন না। তিনি কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন।

     আরো পড়ুন....

পুরাতন খবরঃ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  
error: ধন্যবাদ!