রোহিঙ্গা সংকট ও আন্তর্জাতিক শক্তির স্বার্থপর খেলা-শাকিল

সাইফুল ইসলাম শাকিল, জবি :
রাতের অন্ধকার কেটে পূর্ব প্রভাতের ক্ষীণ আলোচ্ছটায় হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বাসটা এসি করা। গায়ে হালকা শীত অনুভব করছি। আবার দিনটিও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝরা। গায়ের কম্বল খানা সরিয়ে জানালার পর্দা হালকা টেনে দিতেই দেখি বিশাল এক বোর্ডে লেখা ‘শুভ সকাল কক্সবাজার’। বুঝতে পারলাম দীর্ঘ দশ ঘন্টা যাত্রার পর ৪৪০ কি.মি পথ অতিক্রম করে দেশের সর্ব দক্ষিণ জেলায় এসে পৌছালাম।
আমার গন্তব্য আরও আড়াই ঘন্টা যাত্রায় ৮৬ কি.মি. ভেতরে দেশের সর্ব দক্ষিণের উপজেলা টেকনাফের উখিয়া। দেশের দক্ষিনাঞ্চলে এই প্রথম যাত্রা। তাও গুরুত্বপূর্ণ এক দায়িত্ববোধ থেকে; থিসিসের নির্ধারিত বিষয় রোহিঙ্গা ইস্যু। আমি দক্ষিণের বাহিরের মানুষ, একেবারে বাহিরের। আমি শহরে থাকি। এটা উল্লেখ করার বিশেষ কিছু কারণ আছে। শহরের মানুষ এদিকে কী হচ্ছে তা সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানেনা। এরা ততটুকুই জানে, যতটুকু ইন্টারনেটে আসে, পত্র পত্রিকায় আসে। বিশেষ করে ঢাকার মানুষ। তারা পাহাড় সম্পর্কে কিছুই জানে না। এমনকি অনেকে পাহাড় নিয়ে লিখে, তারাও। এ কারণে ভুলভাল লিখে কিংবা উল্টোটা। আর পলিসি মেকাররাও পলিসি বানায় ঢাকায় বসে। কক্সবাজার সম্পর্কে বাইরের মানুষ জানে এটা পর্যটন নগরী। এখানে সমুদ্র আছে। আর রোহিঙ্গারাও আছে। অস্ত্র শস্ত্র আর মাদক পাওয়া যায়। এই মাদক কারা আনে সেটা তারা জানেনা। জানার কথাও না। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় দেখে, তারা পাশ কাটিয়ে যায়। আবার যখন দেখে মাদক বহনের চালানের সময় রোহিঙ্গা আটক, তখন একটা হইহই রব পড়ে যায়। শেষ করে দিল দেশটা রোহিঙ্গারা। ফিরে আসি আড়াই ঘন্টা যাত্রায়। কক্সবাজার থেকে উখিয়ার অভীষ্টে গাড়ি চলছে তীব্র গতিতে। রাস্তাগুলো খুব প্রসারিত নয়। আঁকাবাঁকা সরু পরিসরে রাস্তা এগোচ্ছে। এর মধ্যেই হঠাৎ চোখে পড়া শুরু হলো গুচ্ছাকারে ছোট ছোট ছাউনি ঘেরা অসংখ্য সারিবদ্ধ কুঠরি। বুঝতে বাকি রইলো না এরাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরনার্থী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা। যাদের উপর অগত্যা পাশবিক নির্যাতন করেছে বার্মা। বাস চলতে থাকে আর গুচ্ছাকারে ছাউনির ঘরগুলোর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আমার গন্তব্য লেদা টাওয়ার, আলীখালী ক্যাম্প, টেকনাফ।
ইচ্ছে হলেই তো ঢোকা যাবে না ক্যাম্পে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র আছে আলীখালী ক্যাম্পের দায়িত্বে। ওনার সঙ্গে সামনা সামনি পরিচয় নেই। তবে লেখালেখির মাধ্যমে কিছুটা পরিচয় আছে। তিনি আছেন বেসরকারি সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশান অব মাইগ্রেশান'(আই.ও.এম)এর সাইড ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। টেকনাফ উলজেলা শুরু থেকে লেদা টাওয়ার পর্যন্ত দুচোখে শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্প চোখে পড়ে। উঁচু নিচু সব জায়গায় শুধু শরনার্থীদের ঘোষিত অঘোষিত শিবির। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখেই যাচ্ছি। এই মানুষগুলি রোহিঙ্গা! ংতারাই বাংলাদেশ সরকারের আশ্রিত সর্ববৃহৎ শরনার্থী গোষ্ঠী! বাস থেকে নেমে রিক্সায় করে ২৫নং আলীখালী ক্যাম্পের ১১নং ব্লকে আই.ও.এম অফিসে পৌঁছালাম। ইতিমধ্যে অনেক শরনার্থীরা এসে জমে গেছে। একেকজন এসেছেন একেক সমস্যা নিয়ে। কেউ বিচার নিয়ে, কেউ স্বাস্থ্যগত সমস্যা, কেউ বা এসেছেন ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নিতে। খুব অবাক লেগেছে যে, সরকার এতগুলো মানুষের ডেটাবেইস তৈরি করেছে, যেখানে প্রতিটা মানুষের তথ্য আছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিসর এতোটা বিস্তর যে, প্রতিটা ক্যাম্প আবার ২০-৩০টি ব্লকে বিভক্ত করা। আর যেই ক্যাম্পগুলো পরিসরে আরো ব্যাপক সেখানে ব্লক এবং পরিবারের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। আমি রোহিঙ্গা ভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত নই। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের সঙ্গে ভারবল যোগাযোগটা বেশ কঠিন হবে। কিন্তু একজন ইন্টারপ্রেটার কাজটাকে সহজ করে দিয়েছে। ব্লক-১১ তে প্রবেশ করতেই পুরা হকচকিয়ে গেলাম। আমার সারা জীবনে এমন অভাবনীয় দৃশ্য আমি দেখিনি। পাহাড়ের ঢালে গায়ে গা লেগে সারি সারি ঘর। বাঁশের বেড়া, ওপরে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। এত অল্প জায়গায় এত মানুষের থাকার বাসা। দেখে মৌচাকের মতো লাগছিল। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। ঢাকায় বস্তি এলাকায় গিয়েছি, তার সঙ্গে কিছুটা মিল আছে। কিন্তু ভীষণ সুন্দর প্ল্যান করা। হাঁটার রাস্তা আছে। প্রতি বিশজন মানুষের জন্য বাথরুম আছে। সরকারি অফিস আছে। চিকিৎসা করার ব্যবস্থা আছে। বাচ্চাদের জন্য স্কুল আছে। মসজিদ আছে। এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সরকার কী অবিশ্বাস্য এক কাজ করেছে। এই বিপুল পরিমাণ জনগণকে একটি দরিদ্র দেশ শুধু ঠাঁই দেয়নি, তাদের বাসস্থান, খাদ্য, পোশাক, চিকিৎসা শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। এটা কোনো সহজ কাজ নয়। রোহিঙ্গারা যখন প্রথম আসা শুরু করল, অবস্থা দাঁড়িয়েছিল ভয়ংকর। বিশেষ করে পয়োনিষ্কাশনের সমস্যা দাঁড়িয়েছিল ভয়াবহ। যারাই গেছে সাহায্য করতে সেই ভয়ংকর দুর্গন্ধ অনেকেই সহ্য করতে পারেনি। তৎক্ষণাৎ বমি করে অসুস্থ হয়ে ফিরেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সংখ্যায় কম হলেও বার্মা সেনাবাহিনী তাদের সঙ্গে যে সংকীর্ণতা, অমানুষিকতা, বর্বরতা, নৃশংসতা ও আঞ্চলিকতার শিকার করে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণ করতে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বাধ্য করেছে তা একাত্তরের গণহত্যার মতো একই চরিত্রের। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীও চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু সম্প্রদায় ও জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের বিতাড়িত করে পাকিস্তানপন্থী পূর্বাঞ্চল নতুন করে গড়ে তুলতে। পরিণামে যুদ্ধাবস্থা। এখানেই তফাৎ ছোট্ট জাতি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রতিবাদী চেতনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। প্রতিরোধ যুদ্ধের অবস্থান নেওয়ার মতো চিন্তা ও শক্তি তাদের নেই। এ অবস্থায় কোথায় দাঁড়াবে অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী? তাই তারা পলায়নপর শরণার্থীরূপে বাংলাদেশের দিকে। ১৯৭৮ সালে এবং ১৯৯২ সালে দুই দফায় যেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল পরবর্তীতে সরকারের কূটনৈতিক সফলতায় অধিকাংশ ফিরে গেলেও উল্লেখযোগ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশেই থেকে গিয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগষ্টের পর মায়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ফলে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় যেখানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরনার্থীদের সমাগম এখন টেকনাফ। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ, যেখানে দেশটি মাত্র মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবে ঠিক এমন মুহূর্তে এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থী বাংলাদেশের কাছে যেন তাদের প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। তাদের জীবন রক্ষার্থে সামান্য আশ্রয়ের জন্য। ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেই মানবিক উদারতার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যি বিরলতম। কিন্তু বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের আর কতদিন বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়ে রাখবে? আমাদের মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের স্বল্প আয়ের একটি দেশ। এছাড়াও আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপ বেড়ে যাওয়ার একটি ভয় আছে। যা ইতিমধ্যে আমরা বেশ ভালোই প্রমান পেয়েছি। মিয়ানমার যেভাবে হাতে গোনা পরিবার নিতে চাচ্ছে তাতে সমাধানের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ২০১৭ সালের পর এখন পর্যন্ত একটি রোহিঙ্গা পরিবারকেও পুনর্বাসিত করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী দুই বার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এছাড়া বিভিন্ন আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলোতেও বেশ আগ্রহের সঙ্গে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। কূটনৈতিক তৎপরতা প্রথম থেকেই বাংলাদেশ বেশ উদ্যোগের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও তেমন ইতিবাচক ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আসল চাবিকাঠি কার হাতে? বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে ভারত তার পরম বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এতোটাই কাছের বন্ধু ছিল যে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার হতে মুক্ত হয়ে লন্ডন সফর শেষে দেশের মাটিতে পা রাখার পূর্বে ১০ জানুয়ারি ভারতের মাটিতে পা রেখে সেখানকার জনগণ ও সরকারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে দেশে ফেরেন। কিন্তু বেশ উদ্যোগের বিষয় যে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ভারত খুবই দূরসম্পর্কের পরিচয় দিচ্ছে। বরাবরই চুপ আচরণ করে আসছে ভারত। বলছে ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক মৌলিক নীতি হচ্ছে কোন দেশের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা৷ ভারতের এই চুপ আচরণ বাংলাদেশের জন্য খুবই হতাশার ব্যাপার।
আরেকটি দেশ যা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বেশ গুরুত্বের সাথে জড়িয়ে আছে। চীন। বলতে গেলে শুধু বেইজিং আর দিল্লি ইচ্ছে করলেই এই সংকট সমাধান করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু ইচ্ছে করা আর বাস্তবে ইচ্ছের প্রতিফলন করা এক নয়। রোহিঙ্গা সংকটের প্রথম থেকেই চীন মায়ানমারের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে আসছে। এমনকি জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ বিলে চীন বরাবরই ভেটো প্রদান করে আসছে। চীন ও ভারত পরস্পর-বিরোধী রাজনৈতিক চেতনার হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সমস্যায় এখন একই নৌকায়। কিন্তু চীন কেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরাকানের পক্ষে অবস্থান করছে? এর মূল উদ্দেশ্য কি? এখানে চীনের প্রধান স্বার্থ দুটি। এর একটি হলো অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার পক্ষে তাদের চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতি – যার পাশাপাশি চীন চায় যে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও অন্য কোন দেশ হস্তক্ষেপ না করুক। আর অপরটি হচ্ছে, তাদের কৌশলগত ও বাণিজ্যিক স্বার্থ – যার মূল কথা: তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও তেল-গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য মালাক্কা প্রণালী ছাড়াও মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে আরেকটি স্থলপথকে অক্ষুন্ন রাখা।
এখানে চীনের নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। তিব্বত বা শিনজিয়াং – এই দুই প্রদেশের অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোক বাস করে এবং তাদের সাথে বহু দশক ধরে চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হান সম্প্রদায়ের সংঘাত চলছে। চীন সরকার এই অঞ্চলগুলোকে শান্ত করার জন্য বেশ কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এ নীতি দেখিয়েই তারা চাইছে, অন্য দেশগুলো চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করুক। এটা হচ্ছে একটি দিক। অন্য আরেকটি বিষয় ভুললে চলবে না যে বহু দশক ধরে মিয়ানমার চীনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। এর অনেক কারণ – তবে একটি হলো গত দু দশক ধরে চীনের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হচ্ছে। সেই বাণিজ্য মালাক্কা প্রণালী দিয়ে হয় এবং চীন জানে যে তার সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্ররা চাইলেই চীনের বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারে। এটাকেই বলে চীনের মালাক্কা সংকট। এখন বাণিজ্য পথ খোলা রাখার জন্য চীন যদি সেখানে নৌবাহিনী পাঠায় – তাহলে সংকট আরো ঘনীভূত হবে – যাকে বলে চীনের মালাক্কা ডাইলেমা। সেই মালাক্কা সংকটের কথা মাথায় রেখেই চীন স্থলপথে বিভিন্ন পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল এবং গ্যাস যাতে চীনে পৌছাতে পারে- তার ব্যবস্থা করেছে। এরকম দুটি পাইপলাইন আরাকান অর্থাৎ মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছেছে। ভারতেরও এ ধরণের বিনিয়োগ রয়েছে কালাদান এবং সিটওয়ে বন্দরে – কিন্তু চীনের অর্থনীতির জন্য এ দুটি পাইপলাইন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই চীন চাইছে না যে মিয়ানমার সরকার যেন আরাকানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়, বা আরাকানকে কেন্দ্র করে চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক খারাপ হোক। মূলত ১৯৯০ এর দশক থেকেই চীন মিয়ানমারের সঙ্গে তার সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়েছে ঐ দেশটির গ্যাস মজুদের কথা বিবেচনা করে।
এখন সমস্যা সমাধানের দায় সবটাই যেন বাংলাদেশের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে রয়েছে আন্তর্জাতিক শক্তির স্বার্থপর খেলা। এ অবস্থায় বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র করণীয় কূটনৈতিক যুক্তিবাদী বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। যেমন জাতিসংঘের বিভিন্ন পরিষদে, তেমনি শক্তিমান বিদেশি রাষ্ট্র প্রধানদের স্ব-মতে আনার লাগাতার চেষ্টা চালানো। দরকার প্রতিবেশী ভারতকে সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য চাপ সৃষ্টি করা। বাংলাদেশ ভৌগোলিক ভাবে ভারতের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। এই বিষয়টি সফল কূটনীতির মাধ্যমে ভারতকে অবহিত করতে হবে। সেইসঙ্গে রাশিয়াসহ বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সংলাপ চালানো। কিন্তু শক্তিমানদের খেলার মুখে সাফল্য অর্জন বড় কঠিন বিষয়। তবু হাল ছাড়লে তো চলবে না। জাতিসংঘ নীতিগতভাবে রোহিঙ্গাদের পক্ষে দাঁড়ালেও তাদের সহায়ক শক্তি বলিষ্ঠ নয়। আপতত বাংলাদেশকেই তাই নিজস্বার্থে ও রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে আন্তর্জাতিক দরবারে, বৃহৎ শক্তির কাছে লাগাতার কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। প্রয়োজন গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়া। আপাতত এর কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ জাতিসংঘের একটি উল্লেখযোগ্য সদস্য দেশ। এর একটা উদাহরণ টানা যায়। বাংলাদেশ এতটা প্রভাবশালী যে, জাতিসংঘ যখন সৌদিআরবের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ গঠন করতে যাচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ ভেটো দেয়। জানিয়ে দেয় এরকমটা করা হলে তারা আর শান্তিরক্ষায় ভূমিকা রাখবে না। বাংলাদেশের চেষ্টায় সৌদিআরব যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থেকে বেঁচে যায়।বাংলাদেশ সরকারের সাথেও সম্পর্ক ভালো হয়।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য বহু বছর ধরে কূটনীতিক ভাবে বাংলাদেশ চেষ্টা করলেও পরিস্থিতির উন্নতি তেমন হচ্ছে না। কূটনৈতিক তৎপরতা দৃশ্যমান কোন ফলাফল দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এই সংকটের সবচেয়ে বড় ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে বাংলাদেশ কি যথেষ্ট করছে? অনেকে মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে বাংলাদেশ যেসব ভূমিকা নিয়েছে সেটা যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের কথা চিন্তা করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে খুব অফেনসিভ স্ট্র্যাটেজি নেয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব কিনা সেটা চিন্তার ব্যাপার আছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ কেন জোরালো এবং আক্রমনাতœক অবস্থান নিতে পারছেনা? কারন বাংলাদেশ চায় না মিয়ানমারের কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন এবং আমেরিকার মতো দেশগুলো নীরবতা পালন করছে। সেজন্য বাংলাদেশ জানে যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বড় শক্তিগুলোর সমর্থন পাবে না।
তাছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কোন সামরিক উপায়ে হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ ইচ্ছে করলেই তুরষ্কের সিরিয়ায় আক্রমনের ন্যায় মিয়ানমারে সামরিক আক্রমণ করতে পারবে না। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তুরষ্কে অবস্থানরত সিরিয়ান ৩৬ লাখ শরনার্থীকে ফেরত পাঠানোর জন্য সিরিয়া সীমান্তে একটি সেইভ জোন তৈরী করার লক্ষ্যে কুর্দিদের উপর যে সামরিক আক্রমণ চালায় বাংলাদেশের পক্ষে একইরূপ আক্রমণ করা কতটুকু সম্ভব? এরদোয়ানের হামলায় কুর্দিরা জায়গা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। কারন আংকারা মস্কোর সমর্থন পেয়েছে। এবং আমেরিকার নিরব ভূমিকাও সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কার সমর্থন আশা করবে? না ভারত, না চীন, না রাশিয়া, না আমেরিকা। এছাড়াও গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স এর মতে, বিশ্বে সামরিক শক্তিতে ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৬ তম যেখানে মিয়ানমার ৩৫ তম।
এ সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ তৈরির ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। তাছাড়া বান্দরবান এবং কক্সবাজার ভৌগোলিকভাবে একটি স্পর্শকাতর এলাকা। সেজন্য রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কূটনীতিক ভাবে করার চেষ্টা করতে হবে। মিয়ানমার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে দেশটির বিরুদ্ধে যাতে কোন পদক্ষেপ নেয়া না হয়। সেজন্য চীন এবং রাশিয়াকে পাশে চায় মিয়ানমার। চীন বাংলাদেশেরও বন্ধুপ্রতিম দেশ। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের নীতিকে বাংলাদেশ তেমন প্রভাবিত করতে পারছে না। চীন এমন একটি রাষ্ট্র যারা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নীতির জন্য মিয়ানমারকে প্রয়োজন। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেবার বিষয়টিকে সমর্থন করছে না চীন।
এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশকেই উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে পররাষ্ট্রনীতির মূল বক্তব্য হচ্ছে- “কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব।” এটি ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতির কিছু দুরদর্শি চিন্তা ১৯৭২ সালেই লক্ষ্য করা যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিক ভঙ্গুর একটি দেশকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি পুঁজিবাদকেও প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। এর পেছনে তৎকালিন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট জড়িত ছিল। একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুজিবাদী ব্লক আর অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট ব্লক। নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশের ভারসাম্যপূর্ন অবস্থান নিশ্চিত করতে স্নায়ু যুদ্ধের ঐ সময়ে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদকে সমর্থন করা আদর্শের চেয়ে ছিল অনেকটাই কূটনৈতিক চিন্তার ফসল। এছাড়াও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিরোধীতা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ‘ওআইসি’ সম্মেলনে যোগদানের লক্ষ্য ছিল ঐ পররাষ্ট্রনীতি।
একই ভাবে ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ মূলনীতিকে মাথায় রেখে বহির্বিশ্বে কূটনীতিক চেষ্টা আরো জোরদার করতে হবে। মিয়ানমারের গনহত্যা আর বর্বরতার মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ বিশ্বের সামনে সঠিক ভাবে উপস্থাপন করতে হবে। আমরা কারো সাথেই শত্রুতা চাই না। আমরা চাই বর্তমান রাষ্ট্রহীন ১১লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থীর নিরাপদ নির্বিঘ্ন পুনর্বাসন যেখানে তারা দেশের নাগরিকের মতোই বাঁচার অধিকার রাখবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই হাস্যজ্বলহীন মানুষগুলো শরনার্থী হয়ে অন্যের ঘাড়ে বসে জীবল চালাতে চায় না। আমরা যতটা উচ্ছাসে ভাসিয়ে বলি রোহিঙ্গারা অনেক আয়েশি জীবন যাপন করছে, তারা ফিরে যেতে চায় না। আসলেই তা কতটুকু বাস্তব? কে না চায় নিজের আদি ভিটায় ফিরে যেতে? কে চায় অন্য দেশে শরনার্থী হয়ে অন্যের সাহায্যে জীবন চালিয়ে নিতে? কিন্তু যেই বিভৎসতা তারা দর্শন করে এসেছে বার্মায়, সেখানে খুব সহজে তারা ফিরবে না এটাও স্বাভাবিক। তারা চাচ্ছে একটি নিরাপদ পুনর্বাসন যেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হিংস্রতা দেখতে হবে না। একটি দেশের আর সকল নাগরিকের মতোই বাস করতে পারবে। ক্যাম্পগুলোতে দেখলাম এক অন্যরকম জীবন। যে জীবনের সঙ্গে কোনো পরিচয়ই ছিল না। মানুষের প্রতি মানুষের এই অন্যায় দেখে যেমন মনের ভেতরে ক্ষোভ ফেটে পড়ে, আবার বাংলাদেশ এই অসহায় মানুষদের প্রতি যে সৌহার্দ্য দেখিয়েছে, সেই উদাহরণও বিরল।
লেখক:
জবি শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম শাকিল

     আরো পড়ুন....

পুরাতন খবরঃ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
error: ধন্যবাদ!