নগরীর কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদীর পানির উৎকট দুর্গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। নদীর দুই পাশের এলাকায় মশা-মাছিসহ বিভিন্ন রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে। আবার দুই পাড়ের বাসিন্দারা নদীর তীরে আবর্জনা ফেলে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করেছে। ইতোমধ্যে বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের ‘স্ট্যান্ডার্ড’ মাত্রা অতিক্রম করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া নাব্য রক্ষার্থে অপ্রতুল ড্রেজিংয়ের অগ্রগতিও সামান্য। সরেজমিন ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গছে। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বাতাসে উৎকট দুর্গন্ধ। নদী পাড়ের শত শত কারখানা থেকে রাসায়নিক মিশ্রিত তরল বর্জ্য ও বিভিন্ন সংস্থার ড্রেনেজ বর্জ্য দেদারসে নদীতে গিয়ে মিশে যাচ্ছে। এছাড়া নৌযান থেকে উপর্যুপরি পোড়া তেলসহ নানা বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। শুষ্ক মৌসুম শুরু হতেই এসব এলাকার মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
চর কালীগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ী আলী, আবুল হোসেন, জসিম উদ্দিনসহ একাধিক ব্যক্তি যুগান্তরকে বলেন, নদীর পানির অসহনীয় দুর্গন্ধে এখানকার মানুষ দিশেহারা। নদীর পাড় থেকে দুর্গন্ধ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া কাশি, শ্বাসকষ্ট, বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ সবসময় লেগেই থাকে। বেশি সমস্যায় পড়ছে শিশু ও বৃদ্ধরা।
বুড়িগঙ্গা নদীর কয়েকশ’ পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের শত শত টন বর্জ্য পরিশোধন ছাড়া নদীতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগ, পোস্তা, লালবাগসহ নদীর পাড় এলাকায় অবস্থিত কয়েকশ’ পলিথিন ও প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা, পার্শ্ববর্তী কেরানীগঞ্জের দুই শতাধিক ড্রাইং কারখানাসহ হাজারেরও বেশি কারখানা এবং শ্যামপুর, পাগলা-ফতুল্লা এলাকায় শত শত কারখানা থেকে কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি নদীতে মিশে দূষিত হচ্ছে। বছরের পর বছর এসব কারখানা থেকে হাজার টন টন বর্জ্য নদীতে নিক্ষেপ করলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থা পরিবেশ অধিদফতর নির্বিকার রয়েছে। এছাড়া নদীর দু’পাড়ের গৃহস্থালির বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। বুড়িগঙ্গায় সবচেয়ে বেশি বর্জ্য ফেলছে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বর্পূণ সংস্থা ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশন। এসব সংস্থার ড্রেনের পানি পরিশোধনের পর নদীতে নিক্ষেপের বিধান থাকলেও এখন পর্যন্ত ঢাকায় বর্জ্য ট্রিটম্যান্টের জন্য কোনো তরল বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করতে পারেনি ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু নারায়ণগঞ্জের পাগলায় অবস্থিত ওয়াসার একমাত্র ট্রিটম্যান্ট প্লান্টটি বিগত কয়েক বছর অকেজো রয়েছে। এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন মতুয়াইলে একটি বর্জ্য ডাম্পিং স্টেশন থাকলেও ড্রেনেজ বর্জ্য পরিশোধনের কোনো প্ল্যান্ট নেই। এতে তাদের ড্রেনের মাধ্যমে বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে গিয়ে মিশছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) আহ্বায়ক আবু নাসের খান বলেন, বুড়িগঙ্গার পরিবেশ বাঁচাতে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দফতরকে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে। এসব উদ্যোগের মধ্যে পরিবেশ ও নদীতে দূষিত বর্জ্য নিক্ষেপকারী কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান দূষণ করছে তাদেরও দূষণ রোধে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিন এ খান বলেন, ওয়াসার মাধ্যমে যৎসামান্য নদী দূষণ হচ্ছে। ওয়াসার সুয়ারেজ লাইনের বর্জ্য ট্রিটম্যান্ট করতে কয়েকটি প্ল্যান্ট হাতে নেয়া হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি প্রকল্পগুলো সমাপ্ত করতে ওয়াসা রাতদিন কাজ করে যাচ্ছে। দ্রুত এ সমস্যা সমাধান করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. জাহিদ হোসেন বলেন, আমাদের ড্রেনের পানি সরাসরি নদীতে পড়ছে না। সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক ওয়াসা ও পানি উন্নয়নের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সঙ্গে মিশেছে। ওয়াসাকে ব্যবস্থা নিতে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। এছাড়া নদীর তীরবর্তী এলাকায় নিয়মিত পরিচ্ছন্ন ও নদীতে বর্জ্য না ফেলতে স্থানীয়দের সচেতন করা হচ্ছে। নদীর পাড় সৌন্দর্য বর্ধন করতে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।