নিজস্ব প্রতিবেদক :
মেগাসিটি ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে তীব্রগতিতে ছুটে চলবে দেশের প্রথম মেট্রোরেল- সেদিন আর বেশি দূরে নয়। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে দ্রুতগতিতে কাজ চলছে মেট্রোরেল প্রকল্পের। এর মধ্য দিয়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পৌঁছা যাবে মাত্র ৩৮ মিনিটে। যানজটে অতিষ্ঠ নগরবাসীকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে মেট্রোরেলের প্রথম প্রকল্পের বাস্তবায়ন। ইতিমধ্যে মেট্রোরেলের ভায়াডাক্ট বসানো হয়েছে ৯ কিলোমিটার আর রেললাইন বসানোর কাজও এগিয়ে গেছে ৩ কিলোমিটার। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটি খুলে দেওয়া হবে যাত্রীদের জন্য। এমআরটি লাইন-৬ নামে পরিচিত এ প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪০ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গতকাল সরেজমিন এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের ডিপো এলাকা দিয়াবাড়ী, উত্তরা উত্তর ও উত্তরা সেন্টার স্টেশন এলাকা ঘুরে এবং প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০২৪ সালের মধ্যে এমআরটি লাইন-৬ নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে হাত দেয় সরকার। মোট আটটি প্যাকেজে কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ধাপে ধাপে কাজ শুরু করে প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। প্যাকেজ-১-এর আওতায় প্রথম ধাপে ডিপো নির্মাণে ভূমি উন্নয়নের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। এটি নির্ধারিত সময়ের নয় মাস আগেই শেষ হয়ে যায়। এখান থেকে ৭০ কোটি টাকা সাশ্রয়ও হয়। পরের বছরই প্যাকেজ-২-এর আওতায় অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আগামী জুনে ডিপো এলাকার সমস্ত পূর্তকাজ শেষ হয়ে যাবে। প্যাকেজ-৩ ও ৪-এর আওতায় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও নয়টি স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্যাকেজ-৫-এর আওতায় আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ভায়াডাক্ট ও স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১ আগস্ট। একই সময়ে প্যাকেজ-৬-এর আওতায় কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভায়াডাক্ট ও চারটি স্টেশনের নির্মাণকাজও শুরু হয়। আর প্যাকেজ-৭-এর আওতায় মেট্রোরেলের ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম সরবরাহ ও নির্মাণকাজ এবং প্যাকেজ-৮-এ রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে।
প্রকল্পসূত্রে জানা গেছে, এমআরটি লাইন-৬-এর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। নির্মাণকাজ শেষ করার নির্ধারিত সময়ের অন্তত আড়াই বছর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে। এতে সময় ও অর্থ দুই-ই সাশ্রয় হবে। কাজের গুণগতমান ঠিক রেখে প্রকল্পের কাজ চলছে জানিয়ে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করতে পারব বলে আশাবাদী। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যত সময় যাচ্ছে ততই আমরা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। তা কাজে লাগিয়েই আমরা দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে নিচ্ছি।’ প্রকল্পসূত্র জানান, গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পূর্তকাজের অগ্রগতি হয়েছে ৬৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পূর্তকাজের অগ্রগতি হয়েছে ৩৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম ও রোলিং স্টক (রেলকোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহের কাজের সমন্বিত অগ্রগতি হয়েছে ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর বাইরে এ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য বাড়ছে আরও ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। এর মধ্য দিয়ে এমআরটি লাইন-৬-কে নিয়ে যাওয়া হবে কমলাপুরে। ওই অংশে এখন সোশ্যাল জরিপ কাজ চলছে।
গতকাল প্রকল্প এলাকা সরজমিন ঘুরে ও প্রকল্পসূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, এ প্রকল্পের প্যাকেজ-৩ ও ৪-এর আওতায় উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পরিষেবা স্থানান্তর, চেকবোরিং, টেস্ট পাইল, মূল পাইল ও আই-গার্ডার নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মোট ৭৬৬টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ৭৬১টি, ৩৯৩টি পিয়ার হেডের মধ্যে ৩৮৭টি ও ৫ হাজার ১৪৯টি প্রিকাস্ট সেগম্যান্ট কাস্টিংয়ের মধ্যে ৫ হাজার ১২৩টির নির্মাণ শেষ হয়েছে। আর উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের মধ্যে ৯ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট এখন দৃশ্যমান। বাকি অংশেও ভায়াডাক্ট বসানোর কাজ চলছে। একই সঙ্গে ভায়াডাক্টের দুই পাশে প্রাচীর নির্মাণের কাজও চলছে সমানতালে। এ প্যাকেজে নয়টি স্টেশনের সাব-স্ট্রাকচারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা সাউথ স্টেশনের মিলনস্থল (কনকোর্স) নির্মাণের কাজ চলছে। এ প্যাকেজে কাজের সার্বিক অগ্রগতি হচ্ছে ৬৬ শতাংশ।
প্যাকেজ-৫-এর আওতায় আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ইতিমধ্যে পরিষেবা স্থানান্তর, চেকবোরিং ও টেস্ট পাইল শতভাগ শেষ হয়েছে। এ অংশে মোট ৬২১টি বোরড্ পাইলসের মধ্যে ৬০১টি নির্মিত হয়েছে। মোট ২০৩টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ৭৫টি পাইল ক্যাপ নির্মাণ শেষ হয়েছে। আর ১০৬টি পিয়ারের মধ্যে ৪৭টি পিয়ার নির্মাণ শেষ হয়েছে। ১ হাজার ৪৮টি সেগমেন্টের মধ্যে ১৬০টি নির্মিত হয়েছে। এ অংশে কাজের অগ্রগতি হচ্ছে ৩৮ দশমিক ২০ শতাংশ।
আর প্যাকেজ-৬-এর আওতায় কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪ দশমিক ৯২২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও চারটি স্টেশনের নির্মাণকাজ চলছে। যার মধ্যে এখন পর্যন্ত মূল পাইল নির্মাণের জন্য ৪২৩টি ট্রায়াল ট্রেঞ্চের মধ্যে ৪০৭টি সম্পন্ন হয়েছে। মোট ৮৬২টি স্থায়ী বোরড্ পাইলের মধ্যে ৭৬৬টি, ৯৯৮টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ১১১টি ও ১৬০টি পিয়ারের মধ্যে ৮২টি পিয়ারের কলাম নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ১৩৬টি পিয়ার হেডের মধ্যে ৬০টি পিয়ার হেড ও ১ হাজার ৬২০টি সেগমেন্টের মধ্যে ২০৯টি সেগমেন্ট নির্মাণ শেষ হয়েছে। এ প্যাকেজে কাজের অগ্রগতি হচ্ছে ৪০ দশমিক ২৫ শতাংশ।
বসেছে ৩ কিলোমিটার রেলট্র্যাক : সরেজমিন দেখা গেছে, এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের উত্তরা ডিপো থেকে ১০৪ নম্বর পিয়ার পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার রেলট্র্যাক বসানোর কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এমআরটি প্রকল্পের এমডি এম এ এন ছিদ্দিক আরও জানান, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এ অংশে পুরোটাতেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয়ে যাবে। তিনি জানান, দিনের বেলা যেহেতু ট্রাফিক বেশি এবং মানুষের চলাচল বেশি এ কারণে সেগমেন্ট ও ভায়াডাক্ট বসানোর কাজ বেশ কঠিন, তাই মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত এ দুটি কাজ সম্পন্ন করা হয়। এদিকে প্রকল্পসূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মেলার কারণে গত এক মাস আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত কাজের গতি ছিল খুবই শ্লথ। একইভাবে এখন একুশে বইমেলার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় মেট্রোরেলের কাজ কিছুটা গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। দুই মেলার কারণে যে সময় নষ্ট হচ্ছে তা পুষিয়ে নিতে মেলা শেষ হওয়ার পর দিনে-রাতে কাজ চলবে। প্রয়োজনে শ্রমিকও বাড়ানো হবে। ইতিমধ্যে বাণিজ্য মেলা শেষ হওয়ায় আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশে আবারও দ্রুতগতিতে কাজ শুরু হয়েছে।
থাকবে তিনটি আইকনিক স্টেশন : এমআরটি লাইন-৬-এ মোট স্টেশন হবে ১৬টি। এর মধ্যে তিনটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে আইকনিক। এগুলো হচ্ছে- উত্তরা সেন্টার, বিজয় সরণি ও মতিঝিল। এ তিনটি স্টেশনের দেয়ালে তুলে ধরা হবে দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহ্য। থাকবে নানান কারুকার্য। এসব সৌন্দর্য মেট্রো ব্যবহারকারীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা সুন্দর ও চমকপ্রদ ধারণা দেবে। এর বাইরে বাকিসব স্টেশন হবে একই ধাঁচের।