ভিসির শেষ সময়কে কেন্দ্র করে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষক রাজনীতি। বিগত প্রায় তিন বছর বিভিন্ন ইস্যুতে ভিসির পক্ষে ও বিপক্ষে শিক্ষক নেতাদের অবস্থান থাকলেও শেষ সময়কে ঘিরে বরাবরের মতো সরব হয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রুপগুলো। নানান বিষয়ে দেখা দিয়েছে গ্রুপের নতুন মেরুকরণ। তবে প্রতিবার ভিসির শেষ সময়ে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল থাকার বিষয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতায় শঙ্কিত অনেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী। ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারিতে দায়িত্ব নিয়ে প্রায় তৃতীয় বছরের শেষের দিকে এ ভিসির মেয়াদকাল। বিগত ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আলী আশরাফের শেষ সময়ের অভিজ্ঞতা ছিল খুবই তিক্ত। শেষের প্রায় দেয় মাস তৎকালীন শিক্ষক সমিতির তোপের মুখে কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারেননি তিনি। কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটে তালা ঝুলানো থাকায় অফিস করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারাও। কয়েক দিন অফিস করতে এসে প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় শিক্ষক লাউঞ্জের সামনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেও কার্যালয়ে প্রবেশ করতে না পেরে বাসভবনে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে। এর আগের ভিসি অধ্যাপক ড. এএইচএম জেহাদুল করিমসহ অনেকে পূর্ণ মেয়াদ শেষ করে যেতে পারেননি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে বর্তমান ভিসির শেষ সময়ে কি হতে যাচ্ছে এ নিয়ে প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়েরর সংশ্লিষ্ট সবার মনে। শিক্ষকদের গ্রুপগুলোর পাওয়া না পাওয়া এবং ভিসির পুরো সময় জুড়ে সফলতা ও ব্যর্থতার হিসেব বলে দিবে কি হবে এ ভিসির শেষ সময়ে। বর্তমানে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের বিদ্যমান প্রধান তিনটি গ্রুপে বিভক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি। এর মধ্যে গত ভিসির শেষ সময়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি থাকা অধ্যাপক ড. আবু তাহের বর্তমানে রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এবং শিক্ষক সমিতির সভাপাতি রশিদুল ইসলাম শেখ ও ড. মো. শামিমুল ইসলাসসহ তাদের গ্রুপ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। অপরদিকে শিক্ষা ছুটিতে অস্ট্রেলিয়া থাকা মেহদী হাসান, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপাতি কাজী ওমর সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক মো. জিয়া উদ্দিন এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রবিউল আউয়াল চৌধুরীসহ এ পক্ষের শিক্ষকরা বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছেন।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদ, বিভিন্ন কমিটি এবং গ্রুপের স্বার্থবিরোধী নানা ইস্যুতে ভিসির ওপর অনেকটা অসন্তোষ তারা। এদিকে এ পক্ষের অন্যতম নেতা মেহদী হাসান শিক্ষা ছুটিতে থাকলেও অন্য আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা মোহাম্মদ আইনুল হক সদ্য কানাডা থেকে শিক্ষা ছুটি শেষে দেশে ফেরাতে অনেকটা স্বস্তিতে আছেন গ্রুপের শিক্ষকরা। তবে ভিসির বিষয়ে এ গ্রুপের নেতাদের সুর ভিন্ন হলেও ওমর সিদ্দিকী বলেন আমরা ভিসিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। কেউ অস্থিতিশীল করতে চাইলে বঙ্গবন্ধু পারিষদ তা প্রতিহত করবে। অপরদিকে গেল ভিসির শেষ সময়ে তার পক্ষে থাকা বর্তমান প্রক্টর ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. দুলাল চন্দ্র নন্দীদের গ্রুপটি সরাসরি ভিসির পক্ষে বা বিপক্ষে না থাকলেও সামনের নির্বাচন এবং ভিসির শেষ সময়কে ঘিরে আলোচনায় উঠে এসেছে তারা।
তবে এ গ্রুপের অন্য আরেক নেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈষ্ঠ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সৈয়দুর রহমানকে বিভিন্ন সময়ে ভিসির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সমালোচনা করতে দেখা যায়। নিয়ম ভেঙ্গে বিজ্ঞান অনুষদের ডিন নিযুক্ত করা এবং ভিসির খারাপ আচরণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করে আসছেন তিনি। এসব ইস্যুসহ নানান বিষয়ে এ অধ্যাপকের সাথে গ্রুপটির সম্পর্কের ফাটল ধরেছে। তবে ভিসির শেষ সময় এবং সামনের শিক্ষক সমিতির নির্বাচনকে ঘিরে গ্রুপগুলোর নতুন মেরুকরণ হচ্ছে বলে জানা যায়। এক জৈষ্ঠ নেতা জানান, রেজিস্ট্রার এবং প্রক্টরের গ্রুপের নতুন জোট বাঁধতে দফায় দফায় মিটিংয়ে বসছেন তারা। তবে ভিসিপন্থীদের সাথে জোট হলে প্রক্টরের গ্রুপ থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন সৈয়দুর রহমান। জোটের ফলে নিজ গ্রুপের স্বক্রিয়তা নষ্ট হলে বেরিয়ে এসে নতুন চিন্তা করবেন বলে জানান তিনি। এছাড়াও রেজিস্ট্রার ও প্রক্টরের নতুন জোট গঠন হলে জিয়া উদ্দিন এবং ওমর সিদ্দিকীদের নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে এসে নতুন বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠনেরও গুঞ্জন শুনা যায়। এর আগের ভিসির শেষ সময়েও ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু পরিষদে বিভক্তি দেখা যায়। বিরোধের জেরে পাল্টা কমিটি হলেও পরবর্তীতে তাদের কার্যক্রম দেখা যায়নি। তবে এবার এ জোট হলে নতুন আঙ্গিকে কমিটি আসতে পারে বলে আভাস পাওয়ায়া যায়। এছাড়া কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষাকদেরও সরব হয়ে উঠতে দেখা যায়। এদিকে এযাবৎ কালের সব চেয়ে বড় মেগা প্রকল্প এবং প্রথম সমাবর্তন করে যেভাবে প্রশংসিত হয়েছেন ঠিক বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্বান্ত নিয়েও নানান সময়ে সমালোচনার পাত্র হয়েছেন বর্তমান ভিসি।
ক্যাম্পাসের আশপাশে ভূমি অধিগ্রহণের সুযোগ থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়কে জোরপূর্বক দ্বিখণ্ডিত করা, শুরুরদিকে ‘ডায়নামিক ভিসি’ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ পরিচিতি লাভ করলেও কাজে আশ্বাসে সীমাবদ্ধ থাকা, ফেসবুকে তোষামোদকারীদের প্রাধান্য দেয়া, নিয়মানুযায়ী সিন্ডিকেট সভা না ডাকা, পদ না থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওর্গানোগ্রাম ভঙ্গ করে অর্থ ও হিসাব দপ্তরের ক্যাশিয়ার মো. ছালেহ আহমেদকে সহকারী হিসাবরক্ষণ পদে পদোন্নতি দেওয়া, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধরে রাখা, নিয়মিত অফিস ও জাতীয় দিবসগুলোতে উপস্থিত না থাকা এবং শিক্ষকদের সাথে খারাপ আচরণের অভিযোগসহ নানা ইস্যুতে বিতর্কিত হয়েছেন তিনি। তবে সফলতার সাথে সাথে হয়তো ব্যর্থতার দায়ও এড়াতে পারবেন না তিনি। তবুও এর আগের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এ ভিসির শেষ সময় নিয়েও শঙ্কিত অনেকে।
ভিসির শেষ সময়কে ঘিরে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল হওয়ার বিষয়ে সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আমির হোসেন খান বলেন, আসলে একটা ইন্সটিটিউশনে দাবি-দাওয়া আন্দোলন-সংগ্রাম হতেই পারে। তবে ভিসিদের উচিত নিয়মানুযায়ী তা মানিয়ে চলা। আর শিক্ষকদেরও উচিত অতিরঞ্জন না করে শিক্ষকসুলভ আচরণ করা।
সার্বিক বিষয়ে বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী বলেন, আমি খবর নিয়েছি এর আগে যত ভিসি এসেছেন সবাই খারাপ ছিল না। কিন্তু এখানে এসে সবাই অসম্মানিত হয়ে গেছেন। কেউ যাতে কোনো কথা বলতে না পারে সেজন্য সব কিছু কমিটি বা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে করেছি। তবে সরকার চাইলেও আমি নিজেই আর দ্বিতীয় মেয়াদে থাকব না।