আল ফাতাহ মামুন :: হে আল্লাহ! আমরা কত কমজোরি সৃষ্টি, তবুও আমাদের অহংকারের সীমা নেই। তুমিই তো বলেছ, ‘খুলিকাল ইনসানা দায়িফা। মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করেছি।’
অন্য আয়াতে তুমি বলেছ, ‘ওয়ামা উতিতুল ইলমা ইল্লা কালিলা। মানুষকে সামান্য মাত্র জ্ঞান দিয়েছি।’ এ সামান্য জানা দুর্বল মানুষের এতই অহং যে- তোমাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসে! পৃথিবী থেকে ধর্ম চিরতরে বিদায় করে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর মানুষকে তুমি বুঝিয়ে দিচ্ছ, প্রভুর করুণা ছাড়া এক মুহূর্তও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
তাই তো আজ ঘোর অবিশ্বাসীরাও বলতে বাধ্য হচ্ছে, আমাদের সব চেষ্টা শেষ। এখন আকাশের মালিকের এক ফোঁটা রহমত ছাড়া বাঁচার উপায় নেই।
হে আল্লাহ! আমরা তোমার করুণা ভিক্ষা চাই। আমরা স্বীকার করছি, অতীতের কোনো প্রজন্মই আমাদের মতো জুলুমের সীমা ছাড়ায়নি। আগে তুমি কোনো এলাকায় মহামারী দিতে, এখন পৃথিবীজুড়ে তোমার আজাবের সৃষ্টি করেছ। হে পৃথিবীর মানুষ! প্রভুর আজাব দেখে এখনও কি তোমার হুশ হয়নি? এখনও তোমার ঘুম ভাঙেনি?
যদিও আজাব এসে গেছে, তবুও ক্ষমার হাত বাড়িয়ে প্রভু অপেক্ষায় আছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, আমি আজাব দিই আমার কোলে ফিরে আসার জন্য।
তাফসিরে কাবিরে ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি লিখেন, মানুষ পাওনাদারকে দেখলে পালায়। আমরা গোনাহ করতে করতে আল্লাহর কাছে সমুদ্রসমান ঋণী হয়ে পড়েছি। এখন আল্লাহর কথা মনে হলেই আমাদের মন পালাতে চায়। কিন্তু আল্লাহর থেকে পালিয়ে বান্দা আর কার কাছে যাবে?
তাই আল্লাহ বান্দাকে ডাক দিয়ে বলছেন, লাইলাহা ইল্লাহুয়া ফা আন্নি তুফাকুন। বান্দারে! আমি ছাড়া তোমাদের আর কে আছে? আমাকে ছেড়ে তোমরা কোথায় যাচ্ছ? আসো! আমার ক্ষমার চাদরে আশ্রয় নাও।
প্রভুর কোলে ফিরে আসার শ্রেষ্ঠ সময় এখন। মাহে রমজানের শেষ দশকে লুকিয়ে আছে মানব জীবনের শ্রেষ্ঠতম সফলতার রাত লাইলাতুল কদর।
তাফসিরে মাজহারির লেখক কাজী সানাউল্লাহ লাইলাতুল কদরের সবগুলো হাদিস বিশ্লেষণ করে বলেন, একদল সুফির মতে লাইলাতুল কদর বছরজুড়ে ঘুরতে থাকে। বেশির ভাগ সময় এটি রমজানের শেষ দশকে পাওয়া যায়।
অনেকেই মনে করেন লাইলাতুল কদর একটি নির্দিষ্ট রাত। আসলে লাইলাতুল কদর কোনো নির্দিষ্ট রাত নয়। সিয়াম সাধক যখন সাধনা করতে করতে হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করে ফেলে, অর্থাৎ নিজেকে চিনে ফেলে, তখনই সে প্রভুকে জেনে ফেলে- ওই সময়টিই সাধকের জন্য হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মর্যাদাময় রজনী হয়ে যায়।
সুফি দার্শনিক সদরউদ্দিন চিশতি বলেন, নিজেকে চেনার, প্রভুকে জানার সাধনায় এক হাজার বছরে সাধক যতটুকু এগিয়ে যায়, লাইলাতুল কদরের এক রাতে তার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে যায়।
লাইলাতুল কদর খুঁজতে হয়। কদর খোঁজা মানে প্রভুকেই খোঁজা। প্রভুকে পাওয়া মানেই আপনার জীবনে লাইলাতুল কদর পেয়ে গেলেন। রাসূল (সা.) যখন হেরা গুহায় প্রভুকে পাওয়ার আশায় পনেরো বছর ধ্যান করলেন, তখন এক মহামূল্যবান রাতে হজরতের কাছে রুহ নাজিল হল।
সে রাতটি ছিল মাহে রমজানের শেষ দশকের কোনো একটি বেজোড় রাত। রুহ নাজিল হওয়ার সঙ্গে তিনি পেয়ে গেলেন ফোরকান। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘রমজান মাস সে মাস, যে মাসে নাজিল হয়েছে ফোরকান।’
যদিও ফোরকান বলতে বেশিরভাগ মুফাসসির কোরআনকেই বুঝিয়েছেন, তবে সুফি দার্শনিকরা ফোরকান বলতে খোদায়ি প্রজ্ঞা বুঝিয়েছেন। যার মাধ্যমে বান্দা প্রকৃত ভালো-মন্দ বোঝার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। দুনিয়ার মানুষ যে ভালোর পেছনে, মঙ্গলের পেছনে পাগলের মতো ছুটে বেড়ায়, কদরপ্রাপ্ত মানুষ অন্য জিনিসের পেছনে ছুটে বেড়ায়।
সে জানে, সবাই যা ভালো বলছে তা দু’দিনের, আসল ভালো তা যা চিরদিনের। যা পরকালের।
সুফি সদরউদ্দিন চিশতি বলেন, যখন মানুষের তাকদিরে হাকিকতে কদর জুটে যায়, তখন সে প্রশান্ত আত্মা তথা নফসে মুতমাইন্নার অধিকারী হয়ে যায়। তখন তার ভেতরে-বাইরে পরম শান্তি বর্ষিত হতে থাকে। এ কারণেই নবী-রাসূল, অলি-গাউস-কুতুবরা খালি পেটে, ছেঁড়া জামার ভেতরও পরম তৃপ্তির জীবনযাপন করে গেছেন। এ প্রশান্তি বিরাজ করে হাত্তা ইয়াতলাউল ফজর। ফজর পর্যন্ত।
ফজর মানে হল ভোর। জীবনের ভোর মানে মৃত্যু পর্যন্ত। মুমিনের মৃত্যু মানে হল নতুন জীবনের শুরু। অর্থাৎ কদরপ্রাপ্ত প্রশান্ত আত্মার মানুষগুলো আখিরাতের যাত্রা শুরু করার আগ পর্যন্ত সুখে-শান্তিতে থাকবে।
সংক্ষেপে এ কথার মর্ম হল, তারা দুনিয়াতেই জান্নাতি প্রশান্তি পেতে থাকে। প্রভুর পক্ষ থেকে বেহিসেবি রিজিক তাদের দেয়া হয়। যেমন কোরআনে মরিয়ম (আ.)-এর উদাহরণ দেয়া হয়েছে। আমাদের নবী (সা.) বলেছেন, আমার প্রভু আমাকে খাওয়ান। তিনিই আমাকে পান করান। (বুখারি।)
প্রিয় পাঠক! লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য গভীর সাধনা করতে হয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হল সে সত্যিই হতভাগা। সাধনা করে কারও কদরপ্রাপ্তি না হলেও ক্ষমাপ্রাপ্তি ঠিকই হবে।
রাসূল (সা.) বলেছেন, কদরের রাতে যে সালাতে দাঁড়িয়ে থাকে তার পূর্বের জীবনের সব গোনাহ মাফ হয়ে যায়। তাই আপনিও আপনার মতো করে কদরপ্রাপ্তির সাধনা করুন।
প্রভুকে বলুন, হে আল্লাহ! তোমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাই। ক্ষমা চাওয়া জাতিকে আল্লাহ ধ্বংস করবেন না বলে কোরআনে ওয়াদা করেছেন। ইউনূস নবীর উম্মতকে আল্লাহ আজাব দিয়েও ফিরিয়ে নিয়েছেন শুধু তাদের ক্ষমা প্রার্থনার কারণে।
লেখক : সাংবাদিক