পয়লা রমজান জন্মলাভ করেন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)
মুসলমানদের মাঝে সুফি ঘরানার কাদেরিয়া তরিকার প্রবর্তক হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)। তিনি ছিলেন একাধারে মহান সাধক, ধর্ম প্রচারক এবং তাত্ত্বিক গুরু। একজন সুদক্ষ বক্তা এবং অনুপ্রেরণা দানকারী বা মোটিভেটর হিসেবেও তাঁর সুপরিচিতি রয়েছে। উপমহাদেশে তিনি ‘বড়পীর’ এবং ওলিকুলের শিরোমণি নামে বিশেষ সমাদৃত। হিজরি ৪৭০ খ্রিস্টাব্দের ১ রমজান তথা ইংরেজি ২৩ মার্চ ১০৭৮ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)। বর্তমানে ইরানের জিলান নগরে জন্মগ্রহণ করায় তাঁর নামের সঙ্গে জিলানী উপাধি যোগ হয়। তাঁর বাবার নাম আবু সালেহ, যিনি জন্মসূত্রে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় নাতি এবং হজরত আলী (রা.) ও মা ফাতেমা (রা.)-এর পুত্র ইমাম হাসান (রা.)-এর বংশধর ছিলেন। বাবা আবু সালেহ নিজেও একজন ধর্ম প্রচারক, ওলি এবং খোদাপ্রেমী হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। অন্যদিকে তৎকালে অত্যন্ত পরহেজগার পর্দানসীন এবং ধার্মিক নারী হিসেবে সমাদৃত ছিলেন বড়পীরের মা উম্মুল খায়ের ফাতিমা। বড়পীরের মা ফাতিমা জন্মসূত্রে মহানবী (সা.)-এর আরেক নাতি ও ইমাম হাসান (রা.)-এর ভাই ইমাম হোসেনের বংশধর ছিলেন। বাবা-মায়ের সততা, ধর্ম চর্চা, ইমান ও আকিদা বিষয়ে নানাবিধ ঘটনা ও কিংবদন্তি উল্লেখিত আছে বিভিন্ন গ্রন্থে। বাল্যকালে পারিবারিক পরিবেশেই তিনি কোরআন পাঠ এবং অন্যান্য ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। তবে বিভিন্ন গ্রন্থের বর্ণনা মতে, হজরত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) মাতৃগর্ভে থাকাকালে তাঁর মা ১৫ পারা কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করেছিলেন। আর শুনে শুনে মাতৃগর্ভেই তা মুখস্থ করে ফেলেন বড়পীর (রহ.)। এ ছাড়াও ভূমিষ্ঠের পর থেকে তিনি রমজান মাসে দিনের বেলা কোনো কিছু পানাহার করতেন না বলেও বর্ণিত আছে। ভ্রমণকালে একবার ডাকাতের কবলে পড়েন তিনি। ডাকাতরা তাঁর কাছে কী আছে জিজ্ঞেস করলে তিনি মায়ের দেওয়া স্বর্ণমুদ্রার কথা বলেন। ডাকাত দলের সর্দার অবাক হলে তিনি বলেন, মা তাঁকে সব সময় সত্য বলা শিখিয়েছেন। তাই স্বর্ণমুদ্রা থাকার কথা প্রকাশ করেন। এশার নামাজের অজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় এবং দিনের বেলায় রোজা রাখা তাঁর জীবনের অতি সাধারণ বিষয় ছিল এবং দীর্ঘজীবন তিনি এভাবেই অতিবাহিত করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) ১৮ বছর বয়সে জন্মস্থান জিলান ছেড়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত বাগদাদ শহরে গমন করেন। সেখানে ওস্তাদ আবু সাইদ মুবাররাক মাখজুমি এবং ওস্তাদ ইবনে আকিলের কাছে তিনি ইমাম হাম্বলি মাজহাবের আলোকে শরিয়াহ আইন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। এ ছাড়াও তিনি ওস্তাদ আবু মোহাম্মদ জাফর আল সাররাজের কাছে হাদিস বিষয়ে পড়ালেখা করেন। তবে তাঁর জীবনদর্শনে যে সুফিবাদের প্রভাব ও চেতনা, তার নেপথ্যে রয়েছে তৎকালে বাগদাদে সুফিবাদের প্রাণপুরুষ ওস্তাদ আবুল খায়ের মোহাম্মদ ইবনে মুসলিম আল দাব্বাসের দীক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে হজরত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী বাগদাদ ত্যাগ করেন এবং ২৫ বছর ইরাকের বিভিন্ন মরু অঞ্চলে নীরবে-নিভৃতে মহান আল্লাহর ধ্যান করেন। দীর্ঘ স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে ১১২৭ সালে তিনি বাগদাদে ফেরত আসেন এবং প্রকাশ্যে মানুষকে ধর্মের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দিতে থাকেন। তাঁর নিজের বিদ্যাপীঠ তথা ওস্তাদ আল মাখজুমির শিক্ষালয়ে তিনি একজন ওস্তাদ (শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং হাদিস, তাফসির, বিজ্ঞান, কোরআনের মর্মবাণী প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দিতে থাকেন। ৯১ বছরের দীর্ঘজীবনে তাঁর সংস্পর্শে আসা অসংখ্য ইহুদি ও খ্রিস্টান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। অগণিত ভক্ত, ছাত্র, শুভাকাক্সক্ষী এবং নিকটজনদের কাঁদিয়ে ৫৬১ হিজরির রবিউস সানি মাসের ১১ তারিখ তথা ইংরেজি ১১৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন ওলিকুলের শিরোমণি বড়পীর হজরত আবদুুল কাদের জিলানী (রহ.)। এ দিনটিকে ‘ফাতেহা-ই ইয়াজদহম’ নামে পালন করেন তার ভক্তরা। প্রতি আরবি মাসের ১১ তারিখে বিশেষ প্রার্থনায় মিলিত হন তারা, মৃত্যুর পর ইরাকের বাগদাদস্থ টাইগ্রিস নদীর পূর্বপাড়ে রুসাফা অঞ্চলের বাব-উল-সাইখ নামক স্থানে অবস্থিত নিজের মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে তাঁকে দাফন করা হয়। বর্তমানে সেখানে একটি মাজার রয়েছে। ১৫৩৫ সালে অটোমান সম্রাট সুলতান সুলাইমান এখানে একটি বিশাল গম্বুজ-বিশিষ্ট ইমারত তৈরি করেন, যা আজও বিদ্যমান। মহান আল্লাহ আমাদের পয়লা রমজান কবুল করুন এবং বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর জীবনী থেকে শিক্ষাগ্রহণের তৌফিক দান করুক। আমিন।
রমজানে জন্ম ও মৃত্যু ইবনে খালদুনের
ইসলামের ইতিহাসে অষ্টম শতক থেকে ১৪শ শতক পর্যন্ত সময়কে ‘মুসলমানদের স্বর্ণযুগ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-দর্শন, শিল্প-সাহিত্যসহ সর্বক্ষেত্রে এ সময়ে মুসলমান বিজ্ঞানী, পন্ডিত, দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক এবং শিল্পীরা পৃথিবীর বুকে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। সেই স্বর্ণযুগেরই একজন ইতিহাস বেত্তা, সমাজবিদ, পন্ডিত, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদ আবু জাইয়াদ আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে খালদুন আল হাদরামি; সংক্ষেপে ইবনে খালদুন। ১৩৩২ সালের ২৭ মে তথা হিজরি ১ রমজান ৭৩২ তারিখে বর্তমানে আফ্রিকার উত্তর উপকূলে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ তিউনেশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ইবনে খালদুন। পারিবারিকভাবে এক সম্ভ্রান্ত ও সুশিক্ষিত পরিবেশে কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। যা তাঁকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিখরে উঠতে সাহায্য করে। তিনি আফ্রিকা অঞ্চলের সে সময়কার সেরা শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। ফলে অল্প সময়ে তিনি পবিত্র কোরআন মুখস্থ করেন, আরবি ভাষা রপ্ত করেন এবং হাদিস ও শরিয়াহ আইন (ফিকাহ) শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। পাশাপাশি আলজেরিয়ার গণিতবিদ ও দার্শনিক আল আবিলের হাত ধরে তিনি বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েপড়া মহামারী প্লেগে তিনি তাঁর পিতা-মাতা উভয়কে হারান। তারপরও চলতে থাকে তাঁর জ্ঞানের অন্বেষা। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি তিউনেশিয়ার শাসন কাজের সঙ্গে যুক্ত হন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন। এক পর্যায়ে কন্সটেন্টিপোলের শাসক আবু জিয়াদ তিউনেশিয়া দখল করলে তিনি তা মেনে নিতে পারেননি। তাই আবু জিয়াদ ইবনে খালদুনকে ২২ মাসের কারাদন্ড দেন। আবু জিয়াদের মৃত্যু এবং সময়ের বিবর্তনে তিনি মুক্তি পান এবং আগের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে রাষ্ট্রীয় কাজে মনোনিবেশ করেন। একজন দক্ষ প্রশাসক নীতিনির্ধারক ও কূটনীতিবিদ হিসেবে তাঁর দক্ষতা ও বিচক্ষণতা ছিল সর্বজন বিদিত। তথাপি মূলত তোষামোদিকে সহ্য করতে না পারার কারণে বিভিন্ন সময়ে তিনি শাসকদের বিরাগভাজন হন। তাই তিউনেশিয়া ছেড়ে তিনি হজে যান এবং হজ শেষে আলেকজান্দ্রিয়ায় বসবাস শুরু করেন।
ইবনে খালদুন রচিত বই পৃথিবীর অমূল্য সম্পদতুল্য, যা আজও বিশ্বের অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়। তাঁর কর্মজীবন ও রচনাসমগ্রের ওপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অসংখ্য গবেষক। এ গবেষণা আজও অব্যাহত আছে। তাঁর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম ‘আল মুকাদ্দাম’, যার অর্থ পরিচিতি। এ গ্রন্থে পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তীতে তিনি আরও পাঁচটি বইয়ে আদিলগ্ন থেকে তাঁর সময় পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাস তুলে ধরেন। আরও দুটি বইয়ে তিনি বৃহত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের ইতিহাস ও সমাজব্যবস্থা তুলে ধরেন। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মিল-অমিল বিধয়ে তাঁর তত্ত্ব চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে অনেকের মাঝে। সেই যুগে পবিত্র কোরআনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ তাঁর অতি উঁচু মনের পান্ডিত্যের স্বাক্ষর বহন করে। বর্ণবাদ ও শ্রেণিসংগ্রাম নিয়েও তিনি মূলবাদ মতবাদ দিয়েছেন। ১৪০৬ সালের ১৭ মার্চ তথা আরবি ২৬ রমজান ৮০৮ হিজরি তারিখে মিসরের রাজধানী কায়রোতে ইন্তেকাল করেন জগৎসেরা ইসলামী দার্শনিক ও পন্ডিত ইবনে খালদুন। কায়রোর বাব-আল-নাসর নামক স্থানে সমাহিত করা হয় রমজানে জন্মগ্রহণ এবং রমজানে মৃত্যুবরণ করা এই জ্ঞানতাপসকে।
খন্দকের যুদ্ধের মাঝে রমজান শুরু
বদরের ময়দানে সম্মুখযুদ্ধে মুসলমানগণ সংখ্যায় অল্প থাকা সত্ত্বেও বৃহৎ শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করেন। পরের বছর (৬২৫ সাল) আবারও ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের ওপর হামলা করে। উহুদের ময়দানে সংঘটিত এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই বস্তুত জয়লাভ করতে পারেনি।
হিজরি ৫ সন তথা ইংরেজি ৬২৭ সালে মদিনার চারপাড়ে খন্দক বা বাংকার খনন করে বিপুলসংখ্যক শত্রু সৈন্যের মদিনা আক্রমণ প্রতিহত করা হয়। ইতিহাসের পাতায় এ যুদ্ধকে খন্দকের যুদ্ধ বলা হয়। বিভিন্ন গ্রন্থে এ যুদ্ধ ৬২৭ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়। বর্ণনামতে এ যুদ্ধের সময় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে মুসলমানরা দীর্ঘ সময় নিয়ে খন্দক বা বাংকার খনন করেন এবং মতান্তরে ২০, ২৪ অথবা ২৭ দিন শত্রু বাহিনীকে মদিনায় প্রবেশের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। ‘ইসলামিক হিজরি ক্যালেন্ডার ফর রমাদান-৫ হিজরি’ অনুসারে ৬২৭ সালে রমজান শুরু হয় ২৫ জানুয়ারি থেকে। এ হিসাবসহ অন্যান্য সূত্রে বিশেষত ‘দ্য ইসলামিক ইনফরমেশন ডটকম’ সূত্রে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, ৬২৭ সালে শাওয়াল মাসের শেষ সপ্তাহে এবং প্রথম রমজানে মুসলমানরা খন্দকের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২৩ সালে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। ৬২৪ সালে মক্কার কুরাইশ তথা ইসলামবিরোধীরা মুসলমানদের ধ্বংস করতে জোট বাঁধে। কিন্তু বদরের ময়দানে সম্মুখযুদ্ধে মুসলমানগণ সংখ্যায় অল্প থাকা সত্ত্বেও বৃহৎ শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করেন। পরের বছর (৬২৫ সাল) আবারও ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের ওপর হামলা করে।
উহুদের ময়দানে সংঘটিত এ যুদ্ধে কোনো পক্ষই বস্তুত জয়লাভ করতে পারেনি। ৬২৫ সালেই মদিনায় থাকা ইহুদিরা একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে থাকার চুক্তি ভঙ্গ করে এবং মহানবী (সা.)কে হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এ ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়লে মহানবী (সা.) ইহুদি সম্প্রদায়ের কয়েকজন নেতাকে মদিনা থেকে তাড়িয়ে দেন। এর প্রতিশোধ নিতে বিতাড়িত পক্ষের ইহুদি এবং তাদের সম্প্রদায় মক্কায় থাকা ইসলামের শত্রু তথা কুরাইশদের আমন্ত্রণ জানায় মদিনা আক্রমণের জন্য। এ সময় মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজার। বিপরীতে শত্রুদের জনবল ছিল ১০ হাজার। মদিনা আক্রমণের সম্ভাব্য সময়ের সাত দিন আগে হজরত মুহাম্মদ (সা.) শত্রুর সংখ্যা, আগমনের পথ ও রণকৌশল বিষয়ে অবগত হন। বিপুল সৈন্যকে বাধা দানের কৌশল প্রণয়নের জন্য মহানবী (সা.) সবার সঙ্গে পরামর্শ করেন। এ সময় সালমান ফারসি নামক একজন সাহাবি পাহাড়ের ঢালে এবং উপরের দিকে খন্দক বা বাংকার খনন করে অবস্থানের পরামর্শ দেন, যা গ্রহণ করা হয়। সেই মোতাবেক মদিনায় সেনাবাহিনী ও ঘোড়া প্রবেশের পথে খন্দক বা বাংকার খোদাই শুরু হয়। বর্ণনামতে মুসলমানদের মধ্যে শারীরিকভাবে সক্ষম সবাই দীর্ঘ ছয় দিন ধরে খন্দক খোদাই করেন। বিভিন্ন বর্ণনায় এ সময় রমজান শুরু হয় বলে তথ্য পাওয়া যায়। অপর বর্ণনামতে, এ সময় মদিনাজুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
মদিনাবাসী আসন্ন যুদ্ধে শত্রুর লুটতরাজ থেকে রক্ষা এবং শত্রুর রশদ সংকট তৈরির জন্য আগাম ফসল (মূলত খেজুর) ঘরে তোলে। এমনি এক সংকটময় মুহূর্তে মুসলমানগণ অতি সামান্য খাবার ও পানি খেয়ে রোজা রাখেন ও যুদ্ধ চালিয়ে যান। মহানবী (সা.) স্বয়ং পেটের ক্ষুধা নিবারণ করতে না পেরে পেটে পাথর বাঁধেন। এ সময় এক সাহাবির আমন্ত্রণে মহানবী (সা.) মাত্র দুই-তিনজনের খাবার অলৌকিকভাবে প্রায় এক হাজার মুসলমানের মাঝে বণ্টন করেন বলে বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থ ও অন্যান্য বইয়ে উল্লেখিত।
নির্দিষ্ট সময়ে কুরাইশ বাহিনী মদিনায় প্রবেশের চেষ্টা করে চরমভাবে ব্যর্থ হয়।
প্রথা মোতাবেক সম্মুখযুদ্ধে হজরত আলী (রা.)-এর কাছে পরাজিত হয়ে প্রাণ হারায় কুরাইশদের চৌকস যোদ্ধা আমর। এ সময় প্রচন্ড ধূলিঝড়ে কুরাইশ বাহিনী দিশাহারা হয়ে পড়ে। ফলে এক পর্যায়ে যুদ্ধ ময়দান ছেড়ে মক্কায় ফিরে যায়। এভাবেই পবিত্র রমজান মাসে বিশাল শত্রু বাহিনীর হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা করেন মহান আল্লাহ।
৩ রমজান জন্ম নেন মারওয়ান ইবনে হাকাম
হিজরি ৬৫ সনের ৩ রমজান তথা ইংরেজি ৬৮৫ সালের ১২ এপ্রিল (মতান্তরে ১৩ এপ্রিল) মৃত্যুবরণ করেন ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম শাসক ও প্রশাসক মারওয়ান ইবনে হাকাম ইবনে আবি আলয়াস ইবনে উমাইয়া (সংক্ষেপে মারওয়ান)। তিনি ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওফাতের পর দ্বিতীয় খেলাফত তথা উমাইয়া খেলাফতের চতুর্থ খলিফা। আত্মীয়তার সূত্রে মারওয়ান ছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.)-এর চাচাতো ভাই। হজরত ওসমান (রা.) তাকে সচিব (সেক্রেটারি) হিসেবে নিয়োগ দেন। ৬৫৬ সালের ১৭ জুন বিরোধী পক্ষ হজরত ওসমান (রা.)-এর বাড়ি আক্রমণ করে এবং তাঁকে হত্যা করে। এ সময় মারওয়ান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুদের বাধা দেন এবং নিজেও আহত হন। হজরত ওসমান (রা.)-এর জানাজা ও দাফনের সময়ও উপস্থিত ছিলেন মারওয়ান। হজরত ওসমান (রা.)-এর সঙ্গী হিসেবে তিনি একাধিক যুদ্ধে অংশ নেন এবং পরবর্তীতে পবিত্র কোরআন শরিফের অবিকৃত খ- সংরক্ষণে হজরত ওসমান (রা.)-কে সাহায্য করেন। হজরত ওসমান (রা.)-এর মৃত্যুর পর হজরত আলী (রা.) খলিফা হন এবং হজরত আলী (রা.) হত্যাকা-ের শিকার হলে মুয়াবিয়া খলিফা হন। মুয়াবিয়ার আমলে বাহরাইনের শাসকসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন মারওয়ান। দুই মেয়াদে তিনি মদিনার গভর্নর নিযুক্ত হন। প্রথম মেয়াদে ৬৭৪ থেকে ৬৭৭ এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ৬৬১ থেকে ৬৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি মদিনা শাসন করেন। জীবনের শেষভাগে উমাইয়া খিলাফতের সময় মারওয়ান উমাইয়া সাম্রাজ্যের খলিফা নিযুক্ত হন। ৬৮৪ সালের জুন মাসে তিনি শাসন কাজ শুরু করলেও মাত্র এক বছরের মাথায় হিজরি ৬৫ সালে তৃতীয় রমজানে তিনি মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে দুটি মত পাওয়া যায়। তথ্যমতে মারওয়ান আটটি বিয়ে করেন। তার সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রীর নাম ছিল উম্মে হাসিম ফাখিতা। একদল গবেষকের মতে, মৌখিকভাবে মারওয়ান এ স্ত্রীকে কোনো কারণে চরম অপমান করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে হত্যা করেন তার স্ত্রী ফাখিতা। অপর তথ্যমতে, ৬৮৫ সালে সিরিয়া ও আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক হারে প্লেগ মহামারী দেখা দেয়। এ প্লেগে আক্রান্ত হয়েই মারা যান মারওয়ান। রমজানে জন্মলাভ তার সৌভাগ্যের প্রতীক হলেও তার কপালে কালিমা হয়ে লেপে রয়েছে ইসলামের এক ক্রান্তিকালে ইমাম হুসেইনের (রা.) বিপক্ষে যাওয়া এবং কুখ্যাত ইয়াজিদের পক্ষ অবলম্বন করার ইতিহাস।
ইব্রাহিম (আ.)-এর ওপর ওহি নাজিল ৬ রমজান
ইসলাম ধর্মমতে মহান আল্লাহ মানুষকে হেদায়েত করার জন্য যুগে যুগে নবী-রসুল পাঠিয়েছেন। নবী-রসুলদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় ফেরশতা জিব্রাইল (আ.)-এর মাধ্যমে ওহি বা বাণী প্রেরণের মধ্য দিয়ে। চারজন নবী-রসুলের কাছে প্রেরিত ওহি বা বাণী আসমানি কিতাব বা মহাগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। এসব কিতাবের মধ্যে সর্বশেষ এবং সবচেয়ে বেশি সমাদৃত কিতাব হলো আল কোরআন। যা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে নাজিল হয়। এ ছাড়া হজরত মুসা (আ.)-এর কাছে তওরাত, হজরত দাউদ (আ.)-এর কাছে জাবুর এবং হজরত ঈসা (আ.)-এর কাছে ইঞ্জিল কিতাব নাজিল হয়েছিল। এ চারটি কিতাবের বাইরে নবী-রসুলদের কাছে প্রেরিত ওহি বা বাণী কিতাব আকারে প্রেরিত বা সংকলিত হয়নি। বিচ্ছিন্ন এসব বাণী লিখে রাখা বা প্রকাশ করার মতো কোনো মাধ্যম সেই প্রাচীনকালে ছিল না। ফলে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে নবী-রসুলদের ওপর নাজিলকৃত অধিকাংশ ওহি বা বাণী। উপরোক্ত চারজন রসুল ব্যতীত বাকি নবী-রসুলের ওপর প্রেরিত ওহি বা বাণীর বিষয়ে বিস্তারিত জানা কষ্টসাধ্য। তবে পবিত্র কোরআনের ৮৭ নম্বর সূরা আ’লার ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং হজরত মুসা (আ.)-এর কাছে প্রেরিত বাণীর উল্লেখ আছে। পবিত্র কোরআনের এ বাণীতে ইতিপূর্বে অনুরূপ বাণী হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত মুসা (আ.)-এর কাছে প্রেরিত হয়েছিল বলে ১৯নং আয়াতে বর্ণনা রয়েছে। অপরদিকে একাধিক হাদিস ও অন্যান্য গ্রন্থে পবিত্র রমজান মাসের ৬ তারিখে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর কাছে ওহি প্রেরিত হয়েছিল বলে উল্লিখিত। এর মধ্যে মাসনাদ আহমাদ সংকলিত ১৬৫৩৬ নং হাদিসে বলা হয়েছে, ওয়াজিলা ইবনে আসকা থেকে বর্ণিত, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ওপর রমজান মাসের প্রথম তারিখ রাতে ওহি বা বাণী নাজিল হয়েছিল। হজরত ইব্রাহিম (আ.) বহুকাল আগে জন্মগ্রহণ করায় তাঁর জন্মের সঠিক সাল বা তারিখ নির্ণয় কষ্টসাধ্য। তবে একদল গবেষকের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১৮১৩ অব্দে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৩৮৩৩ বছর আগে হজরত ইব্রাহিম (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন। মহান আল্লাহ বর্তমান ইরান, ইরাক, তুরস্ক প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষকে মূর্তিপূজার বদলে এক আল্লাহর আনুগত্য করার বাণী প্রচারের দায়িত্ব দেন। এ নিয়ে মূর্তি উপাসকদের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলে তাঁকে বিশাল আগুনের কু-লিতে নিক্ষেপ করা হয়। মহান আল্লাহর নির্দেশে আগুনের মধ্যেই তিনি জান্নাতসম সুখ অনুভব করেন এবং সাত দিন পর আগুনের কু-লি থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসেন। পবিত্র কোরআনের ২১ নম্বর সূরা আম্বিয়ায় এ সংক্রান্ত বর্ণনা রয়েছে। আর দ্বিতীয় সূরা বাকারার ১২৭ নম্বর আয়াতে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) কর্তৃক পবিত্র কাবাঘরের ভিত্তি স্থাপনের তথ্য রয়েছে এবং যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে ইজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘর নির্মাণ করেন, সেই পাথরটি তাঁর পায়ের ছাপসহ কাবা শরিফ চত্বরে সংরক্ষিত আছে, যা মাকামই ইব্রাহিম নামে পরিচিত।
মুসা (আ.)-এর ওপর নাজিল হয় তাওরাত
পবিত্র কোরআনে সর্বাধিক উল্লেখিত ব্যক্তির নাম হজরত মুসা (আ.)। গবেষকদের মতে, পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সূরায় অন্তত ৭০ বার হজরত মুসা (আ.)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন বর্ণনায় পরোক্ষভাবে মুসা (আ.) এবং তাঁর সম্প্রদায়ের নাম বহুবার উল্লেখিত হয়েছে। হজরত মুসা (আ.) বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন। এ সম্প্রদায়ের নামও পবিত্র কোরআনে বারবার উঠে এসেছে। তবে ইসলাম ছাড়াও ইহুদি, খ্রিস্টান ও বাহাই ধর্মগ্রন্থে হজরত মুসা (আ.) একটি বহুল আলোচিত নাম। যদিও অন্যান্য গ্রন্থে তাঁকে ‘মোসেস’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্বল্প পরিচিত ধর্ম বা ধর্মীয় মতবাদেও হজরত মুসা (আ.)-এর নাম উল্লেখিত আছে। পবিত্র কোরআনে বহুল আলোচিত হলেও হজরত মুসা (আ.)-এর নামে কোনো সূরা নাজিল হয়নি। বরং বিভিন্ন সূরায় শিক্ষামূলক ও উদাহরণমূলক তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে হজরত মুসা (আ.) এর নাম উচ্চারিত হয়েছে। ইহুদি ধর্মমতে হজরত মুসা (আ.) খ্রিস্টপূর্ব ১৩৯১ থেকে ১২৭১; এই ১২০ বছর বেঁচে ছিলেন। বাবা আমরাম ও মা জোশেবেদের ঘরে মিসরে জন্মগ্রহণ করেন হজরত মুসা (আ.)। মিসরে তখন ফেরাউন বংশের রাজত্ব চলছিল। আর সে যুগের প্রথা অনুসারে সম্রাট কাবুস (বংশীয় প্রধান) ‘ফেরাউন’ নামে পরিচিত ছিলেন। ফেরাউন একদা স্বপ্ন দেখেন যে, বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের [হজরত মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়] জন্ম নেওয়া এক পুত্রসন্তান দ্বারা তিনি বিতাড়িত হবেন। এতে ভীত হয়ে এবং অন্যদের পরামর্শক্রমে তিনি বনি ইসরাইল বংশে শিশুপুত্র জন্ম নিলে তাকে হত্যার আদেশ দেন। হজরত মুসা (আ.) এর মা গোপনে তাকে জন্ম দেন এবং লুকিয়ে রেখে বুকের দুধ পান করিয়ে কিছুটা বড় করেন। সম্ভাব্য তিন-চার মাস বয়সে ফেরাউন বাহিনীর কাছে ধরা পড়ার ভয়ে মা জোশেবেদ তার শিশুপত্র মুসা (আ.)-কে একটি ঝুড়িতে ভরে নীলনদে ভাসিয়ে দেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের ২৮ নম্বর সূরা কাসাসের ৭নং আয়াত মতে, মহান আল্লাহ হজরত মুসা (আ.)-এর মাকে তার পুত্র মুসা (আ.)-কে বুকের দুধ পান করিয়ে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং অভয় দিয়ে বলেন যে, তিনি (আল্লাহ) মুসা (আ.)-কে তাঁর মায়ের কাছেই ফেরত আনবেন এবং পয়গম্বরে পরিণত করবেন। একই সূরায় পরবর্তীতে নদী তীর থেকে উদ্ধার হয়ে স্বয়ং ফেরাউনের স্ত্রীর কোলে আশ্রয় লাভ এবং দুধ পানের জন্য আবারও মায়ের কোলে ফিরে আসার বর্ণনা রয়েছে। এভাবে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সূরায় হজরত মুসা (আ.)-এর জীবনে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনার বর্ণনাসমূহ রয়েছে। এমনই এক অলৌকিক ঘটনার বর্ণনায় জানা যায়, হজরত মুসা (আ.) ঘটনাচক্রে মিসর ত্যাগ করে মাদইয়ান নামক স্থানে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি বিবাহপূর্বক ১০ বছর অতিবাহিত করেন। এরপর ফেলে আসা মা ও নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে দেখার জন্য দুর্গম মরু ও পাহাড়ি পথ ধরে মিসরের দিকে রওনা করেন। পথিমধ্যে তিনি তুর পাহাড়ের পাদদেশে রাতে আশ্রয় নেন। তীব্র ঠা-ার মধ্যে তিনি কিছুটা দূরে আগুন দেখতে পান এবং আগুন সংগ্রহের জন্য এগিয়ে যান। কিন্তু আগুনের কাছে যাওয়ার পর আগুন সরে যায় এবং আগুনের মধ্য থেকে গায়েবি আওয়াজ বেরিয়ে আসে। ইসলামী চিন্তাবিদদের ব্যাখ্যা মতে, এ আগুন ছিল মূলত আল্লাহর নূর এবং গায়েবি আওয়াজ ছিল মূলত আল্লাহর ওহী বা বাণী। বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থ বিশেষত মসনদ শরিফের ১৬৫৩৬ নং হাদিস মতে, মুসা (আ.)-এর ওপর ওহী নাজিল হয় ষষ্ঠ রোজার পর; যা তাওরাত কিতাব বা ধর্মগ্রন্থে পরবর্তীতে সংকলিত হয়। পবিত্র কোরআনের ২০ নম্বর সূরা তা’হার ৯ থেকে ১৩ নম্বর আয়াতে এ কুদরতি আগুন পরবর্তীতে তাঁকে (পয়গম্বর) মনোনীত করার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। একই সূরার পরবর্তী ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ হজরত মুসা (আ.)-কে উদ্দেশ করে বলেন- ‘আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। অতএব তুমি আমার উপাসনা কর ও আমাকে স্মরণ করে নামাজ কায়েম কর।’
আরও দুটি যুদ্ধ
৬২৭ সালের জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখে পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়, যা ছিল হিজরি ৬ সনের রমজান। একই মাসে মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী আল মুরায়সি নামক স্থানে মুসলমান এবং বিধর্মীদের মাঝে একটি যুদ্ধ হয়। মুসলমানদের পক্ষে এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন হজরত মুহাম্মদ (সা.), হজরত আবু বকর (রা.) এবং হজরত সা’দ ইবনে উবাইদা (রা.)। এ যুদ্ধে বিধর্মী সম্প্রদায় সম্পূর্ণ পরাস্ত হয় এবং প্রায় ২০০ পরিবারের সবাই বন্দী হয়। এ ছাড়াও এ যুদ্ধের মাধ্যমে তৎকালীন প্রথা অনুসারে বিপুল সংখ্যক উট, ভেড়া, ছাগল ও গৃহ সামগ্রীর মালিকানা লাভ করে। ৬৩২ সালের ৮ জুন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওফাত ঘটে। এরপর হজরত আবু বকর (রা.) খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় বিভিন্ন কারণে চারদিকে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। নতুন মুসলমানদের মধ্যে যারা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুগত্য মেনে নিয়েছিলেন তাদের অনেকেই হজরত আবু বকর (রা.)-এর প্রতি আনুগত্য দেখাতে অস্বীকার করেন। আবার কেউ কেউ নিজেকে নবী, পয়গম্বর বা খলিফা হিসেবে দাবি করেন। হজরত আবু বকর (রা.) এদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করেন। এমনকি একটি অভিযান পরিচালিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান দেশ সালতানাত অব ওমানে। এ অঞ্চলের তৎকালীন শাসক লাকিদ ইবনে মালিক নিজেকে নবী দাবি করেন এবং হজরত আবু বকর (রা.)-এর বিরোধিতা করেন। এর জবাবে হজরত আবু বকর (রা.) মুসলমান সেনাপতি হুদাইফা বিন মিহসানকে ওমানে অভিযানের দায়িত্ব দেন। ৬৩২ সালের ১৯ নভেম্বর পবিত্র রমজান শুরু হয়। একই সময়ে চলে এ অভিযান। অভিযান চলাকালে ডিব্বা নামক স্থানে এক যুদ্ধে ওমানের শাসক লাকিদ ইবনে মালিক মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্য দিয়ে মুসলমানদের জয় হয় এবং অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া সেনাপতি হুদাইফা ওমানের শাসক নিযুক্ত হন এবং আশপাশের আরও কিছু বিদ্রোহ দূর করেন।