দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা শুধু বিনোদনের নামে যাচ্ছেতাই অনুষ্ঠান এবং নাটক নির্মাণ করে চলেছি…
বলা হয় টেলিভিশন যন্ত্রটি এ যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় গণমাধ্যম। এই যন্ত্রটির প্রতি সবারই একটু অন্যরকম আকর্ষণ থাকে। কারও শিল্পী হওয়ার প্রত্যাশায়, কারও বা মালিক হওয়ার বাসনায়। যন্ত্রটির প্রচার ক্ষমতার কারণে এ মাধ্যমটির পাওয়ার বা ক্ষমতাও অনেক। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এই যন্ত্রটির প্রথম আবির্ভাব ঘটে। আর মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর টেলিভিশনটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে রূপান্তরিত হয়। এক সময় বিত্তশালীদের ঘরে এই যন্ত্রটি শোভা পেত। আর এখন ঘরে ঘরে শোভা পায়। বর্তমান বিশ্বকে ড্রইংরুমে নিয়ে এসেছে এই টেলিভিশন। এক সময় টিভি ছিল সাদা-কালো। এরপর ১৯৮০ সালে এলো রঙিন টিভি। শুধু রঙই নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে টিভির আকৃতি ও প্রকৃতি। এসেছে নানান ব্র্যান্ডের টিভি। স্মার্ট টিভি, এলইডি টিভি, এলসিডি টিভি, এনড্রয়েড টিভি, ফোরকে টিভি ইত্যাদি। বাহারি নাম, বাহারি ডিজাইন। টিভি দেখতেও সুন্দর হয়েছে, সুবিধাও বেড়েছে অনেক। রয়েছে ওয়াইফাই সুবিধাও। কিছু কিছু টেলিভিশন এখন টেবিল থেকে দেয়ালে উঠে গেছে। এই টিভিরই বৈচিত্র্যহীন অনুষ্ঠান আর মান দেখে মানুষের পিঠও দেয়ালে ঠেকে গেছে। আগে পুরো মহল্লা বা গ্রামে একটি মাত্র টেলিভিশন ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে সেই গ্রামে এসে মানুষ উঠোনে পাটি বা চাদর বিছিয়ে টিভি দেখত। ব্যাটারি দিয়ে টিভি দেখতে হতো বলে সে সময় রঙিন টিভি দেখা যেত না। তবে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্য অনেকে টিভির পর্দার সামনে রঙিন কাচ ব্যবহার করত। সে সময় সাদা-কালো টিভি দেখতেও মানুষ ভিড় করত। এরপর আর দূর-দূরান্তে গিয়ে টেলিভিশন দেখতে হতো না। মোটামুটি ঘরে ঘরে টেলিভিশন পৌঁছে যায়। মানুষ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে টিভি দেখার সুযোগ পায়। এরপর একই বাড়িতে প্রতিটি কক্ষেই টেলিভিশন অর্থাৎ এক বাড়িতে একাধিক টেলিভিশনও দেখা যায়। শুধু বাড়িতে বাড়িতে টেলিভিশনের সংখ্যাই বাড়েনি, বেড়েছে চ্যানেলের সংখ্যাও। ১৯৯৭ সালের ১৫ জুলাই এই দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেলের যাত্রা শুরু এটিএন বাংলার মাধ্যমে। এই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে মোট ৩৩টি চ্যানেল, সঙ্গে বিদেশি শতাধিক চ্যানেল। এই চ্যানেলের সঙ্গে অনুষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে, বেড়েছে দর্শক সংখ্যাও। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি-আমাদের দেশীয় অনুষ্ঠানের টেলিভিশন দর্শক বাড়েনি। বেড়েছে পার্শ্ববর্তী দেশের কিছু সিরিয়াল দেখার দর্শক। রাতে পিক আওয়ারে বিভিন্ন বাড়িতে শোনা যায় স্টার প্লাস, স্টার জলসা, জি বাংলা নামক চ্যানেলের বিভিন্ন চরিত্রের কণ্ঠস্বর আর মিউজিকের শব্দ। উদ্ভট সব মিউজিক। অনেকেই এসব সিরিয়াল শুধু দেখছেই না, যেন গিলছে। এখন দেশি টিভির টিআরপি নেই, টিআরপি সব ওখানেই। অথচ এক সময় বুস্টার দিয়েও ভারতের দর্শকরা আমাদের চ্যানেল দেখত আর আমরা রঙিন জগতে ঢুকেও আমাদের চ্যানেল দেখাতে পারছি না। আমরাও দেখছি না। ভারতীয় চ্যানেলের সর্বদা কুটনামির কূট-কলহ দাঙ্গা-সংসার ভাঙা-পরকীয়া প্রীতি-নষ্ট সংস্কৃতির নাটক দেখছি। ইত্যাদির একটি পর্বে এই টিভি সম্পর্কেই আমরা বলেছিলাম-
‘একটা মাত্র টিভি চ্যানেল ছিল দেশে আগে
তখন/নাটকগুলোর মান ছিল, সুন্দর সুন্দর গান ছিল
ভিনদেশিরাও বুস্টার দিয়ে দেখত অনুষ্ঠান
সে সব দেখে গর্ব হতো, উঠত জেগে প্রাণ
আর এখন-
চ্যানেল অনেক-অনেক প্রোগ্রাম
দেখার মানুষ নেই
পরিমাণে সব বেড়েছে
মান কমেছে ভাই।
বাড়ি বাড়ি টিভি আছে, কারও রুমে রুমে
টিভিগুলো চলতে থাকে, মানুষ থাকে ঘুমে।’
আসলে এখন টিভির আকৃতি, প্রকৃতি, রঙ কিংবা সুবিধা যতই বাড়ুক না কেন দর্শকদের আকর্ষণ করতে পারছে না। অথচ আমাদের কারিগরি সুবিধা বেড়েছে, প্রতিভাবান নির্মাতা বেড়েছে, নিত্যনতুন ক্যামেরা এসেছে, প্রযুক্তি সুবিধা বেড়েছে-তারপরও কেন দর্শকরা আমাদের চ্যানেল দেখছে না। এসব বিষয় নিয়ে দেশের সাংস্কৃতিক বোদ্ধারা বারবার বলেছেন, আমি নিজেও আমার অনুষ্ঠানে বলেছি, পত্রিকায় লিখেছি কিন্তু উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। বরং অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ লেগেই আছে। কেউ বলছেন বাজেট স্বল্পতার কথা, কেউ শিল্পী সম্মানীর, কেউ নির্মাতার দুর্বলতা, আবার কেউ বলছেন ভালো গল্পের অভাবের কথা। নানাবিধ সমস্যা। সমস্যা যাই হোক মান যে কমছে এটা সর্বজন স্বীকৃত এবং যা খারাপ লক্ষণ। অথচ একসময় এই টিভিতেই কত সুন্দর সুন্দর নাটক হতো। দর্শকরা সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করত সেই সব নাটক দেখার জন্য। চমৎকার সব পারিবারিক নাটক। যেখানে উঠে আসত আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা, সুসম্পর্কের কথা। আদর্শের কথা। বাবা-মা সন্তানদের ডেকে নিয়ে একসঙ্গে বসে সে সব নাটক দেখতেন। কারণ তখন নাটক ছিল শিক্ষণীয়। এমনি ভূরি ভূরি নাটকের নাম বলা যায় সে সময়ের।
আমরা বলি, নাটক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার, এখনকার নাটকে কি সেই চিত্র খুঁজে পাই? এখন নাটকে বাবা-মা, চাচা-চাচি, মামা-মামি, খালা-খালু, দেবর-ননদ কিংবা শালা-দুলাভাইয়ের কোনো চরিত্রই নেই। এখনকার নাটকের পাত্রপাত্রীদের কোনো জন্ম পরিচয় পাওয়া যায় না। আদৌ তারা কি এতিম নাকি অন্য কিছু? একটি মোবাইল ফোন, একজন বন্ধু আর নায়ক-নায়িকা এই হচ্ছে নাটক। প্রেম কীভাবে করা হবে, প্রেম করলে কী হবে, না করলে কী হবে, প্রেমের পথে কাঁটা থাকলে তাকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হবে-এই হচ্ছে নাটকের গল্প। সঙ্গে বিকৃত ভাষার সংলাপ। নাটকের নামও উদ্ভট। সবাই মিলে যেন ভাষাকে বিকৃত করার মহোৎসবে মেতেছে। নিয়ন্ত্রণ করার যেন কেউ নেই, আর থাকবেই বা কী করে। যারা নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই চ্যানেল মালিকরাই এখন এজেন্সিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এজেন্সিরা এসব মানটানের ধার ধারে না। তারা দেখে শিল্পী কে। এসব উদ্ভট প্রেম-পিরিতি মার্কা নাটকের জন্য কিছু বান্ধা শিল্পী আছে। এদের দিয়েই নির্মাণ করা হয় এসব নাটক। যা সব শ্রেণির দর্শককে আকর্ষণ করে না, ফলে অনেক দর্শকই রিমোট টিপে চলে যান ওপারে।
এখন টিভি চ্যানেলের সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী সংখ্যাও বেড়েছে। কাজের মানের চেয়ে সংখ্যাটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেশাদারিত্বের মনোভাব কমে গেছে, তারকা খ্যাতি মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের টিভি চ্যানেলের ক্যানেলে ক্যানেলে এখন ভেসে বেড়াচ্ছে শত শত তারকা। এখন সহজেই তারকা হওয়া যায়। হওয়া যায় কিংবদন্তি। এসব বিশেষণ কিছু কিছু টিভি চ্যানেল এবং পত্রিকার বিনোদন পাতার অবদান। সদ্য টিভি পর্দায় আবির্ভূত নতুন শিল্পীর ক্ষেত্রেও এই তারকা শব্দটি ব্যবহার করা হয়। বাস্তবেও আজকাল তারকা নির্ধারণের মাপকাঠি বোঝা মুশকিল। ইদানীং অনেকেই স্টাইল করে কোনো অনুষ্ঠান বা শুটিংয়ে সবার শেষে আসে। উদ্দেশ্য দৃষ্টি আকর্ষণ।
এই বিলম্বে আসাটাও এখন তারকা বিচারের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু অনুষ্ঠানই নয়, নাটক নির্মাণের সময়ও এই তথাকথিত তারকারা সেটে বিলম্বে আসেন এবং বিলম্বের কারণ জানতে কল করলেও ধরেন না। এই ফোন না ধরাটাও এক ধরনের তথাকথিত তারকারীতি। ইদানীং মিডিয়ায় একটি শব্দ বেশ পরিচিত, তা হলো- ‘শিডিউল ফাঁসানো’। এই শ্রেণির শিল্পীরও অভাব নেই। এরা কখনোই স্ক্রিপ্ট পড়ে আসেন না। একসময় টেলিভিশন নাটকে মহড়া দেওয়া এবং স্ক্রিপ্ট পড়া ছিল বাধ্যতামূলক। দেশের বড় বড় শিল্পী উৎসাহের সঙ্গে সময়ের আগেই মহড়া দিতে চলে আসতেন টিভি ভবনে। আর এখন দৃশ্য ধারণের আগে স্ক্রিপ্টে চোখ বোলানো যেন রীতি হয়ে গেছে। তারপর নিজের মনে যা আসে তাই বলতে থাকেন। ভয়াবহ ট্যালেন্ট! যার নমুনা আমরা পর্দায় দেখতে পাই। নতুন নির্মাতারা এদের কাছে বন্দী। কিছু বলতেও পারেন না। এরাই আবার কিছু কিছু সাংবাদিক, টিভি চ্যানেল ও এজেন্সির কাছে তারকা! চ্যানেলগুলোও এদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। কিছু কিছু নির্মাতাই এসব তথাকথিত তারকার সময়জ্ঞান এবং ‘আমি কী হনুরে’-জাতীয় মানসিকতা তৈরির জন্য দায়ী। মূলত যারা তারকা তারা ঝরে পড়ে না। বছর যায় বছর আসে কিন্তু তাদের এই ইমেজ ঠিক থাকে। তার প্রমাণ আমরা দেখছি। তারকা খেতাব পাওয়া মানেই প্রকৃত শিল্পী হওয়া নয়।
আমরা হা-হুতাশ করতে থাকি- বাজেট নেই বাজেট নেই, ভালো নাটক হবে কী করে! প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি ভালো মানের নাটক দিতে পারছি? ভালো গল্প দিতে পারছি? ভালো নাটক হলে বাজেটের কি আদৌ অভাব হয়? এখনকার নাটক, গান, আড্ডার অনুষ্ঠান- এর অবস্থা কী দেখলেই বোঝা যায় কিংবা সেলিব্রেটিদের টকশোগুলোর বিষয়বস্তুই বা কী? কে কাকে বিয়ে করেছেন, কে কতবার ডিভোর্স দিয়েছেন, কেন দিয়েছেন, আবার কাকে বিয়ে করেছেন, কেন করেছেন, বিয়েতে কী কী খাওয়া হয়েছে, আবার কবে বিয়ে করবেন। কার গার্লফ্রেন্ড কে, বয়ফ্রেন্ড কে, কার সঙ্গে কার কেমিস্ট্রি ভালো- এসব যদি হয় আলোচনার বিষয়বস্তু তাহলে দর্শকই বা থাকবে কেন? পরিবার নিয়েই বা এসব অনুষ্ঠান দেখবে কে? মধ্যরাতের টকশোগুলো নিয়েও অনেকের অভিযোগ- ওখানে যে ধরনের আলাপ-আলোচনা হয় এবং যে ভঙ্গিতে হয় এবং যেভাবে অনেকের মিথ্যাচার চলে- তা দেখে এ প্রজন্ম কী শিখবে? টকশোগুলো শুধু কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও হতো, মাঝেমধ্যে ওখানে হুঙ্কার, চিৎকার, হাতাহাতি পর্যন্ত হয়। ভাগ্যিস মধ্যরাতে হয় বলে অনেকেই অনুষ্ঠানগুলো দেখে না। প্রমাণস্বরূপ ইউটিউবের কল্যাণে এসব হাতাহাতির অফ দ্য রেকর্ড আলাপের ফুটেজও দর্শকরা দেখেছে। আজকালকার টকশোগুলোয় ব্যক্তির চেহারা দেখলেই বোঝা যায় তিনি কী বলবেন এবং কেমন করে বলবেন। এক একজন এতবার বিভিন্ন চ্যানেলের টকশোয় এসেছেন যে দর্শকদের কাছে তাদের মুখের এবং শরীরের দুটি ভাষাই পরিচিত। কথা শোনার প্রয়োজন হয় না। শুধু আলোচনাই নয়, অনেক সঞ্চালকের বিরুদ্ধেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগের কারণে অনেক সময় বক্তাকে উঠে যেতেও দেখা গেছে। আর কিছু কিছু উপস্থাপকের আচরণ দেখলে মনে হয়, তারা বক্তাকে ধমকাচ্ছেন। এমনকি বাড়ির দর্শক যারা ফোন করেন, তাদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করা হয়। বাড়ির দর্শকদের প্রশ্ন নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। কিছু কিছু চ্যানেলে দেখা যায়, একটি যদি এক পক্ষের ফোন হয়, অন্যটি হয় অন্য পক্ষের। এসব ফোনের দর্শকরাও নিজেদের লোক কিনা সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আর গানের অনুষ্ঠানের কথা বলে লাভ নেই। এখন গান শুধু শোনার নয়, দেখার বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে। এখন হিট মানে নাকি ‘ভাইরাল সং’। একসময় মিউজিক ভিডিও ছিল না, দর্শকরা গান শুনতেন। এখন যারা গান শুনতে চান, তারা আর টেলিভিশনকে গান শোনার জন্য উপযুক্ত স্থান মনে করেন না। তারা কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইল ফোনেই নিজের পছন্দের গান শোনেন। টেলিভিশনের গানের অনুষ্ঠান মিউজিক ভিডিওর কল্যাণে এখন হয়ে গেছে নাচের অনুষ্ঠান। আর বেশির ভাগ গানের কথাও শ্রবণযোগ্য নয়। ইদানীং চ্যানেলগুলোর খবরেও আত্মপ্রচার লক্ষ্য করা যায়। কিছু কিছু চ্যানেলের মালিকদের অনুষ্ঠান বা সংবাদ হেডলাইনে চলে আসে। অর্থাৎ নিজেকে নিজের চ্যানেলে জাতীয় ব্যক্তিত্ব বানানোর চেষ্টা। আর হবেই বা না কেন, এসব চ্যানেলের সুবিধা ব্যবহার করে অনেকে আবার বড় বড় পুরস্কারও পেয়েছেন। যে কারণে পুরস্কারও হয়েছে বিতর্কিত।
টেলিভিশন আর টেলিভিশনের শিল্পী নিয়ে অনেক কথাই বলা হলো। কারণ একটাই, আমাদের সংস্কৃতির পরিধি অনেক ব্যাপক এবং এ সংস্কৃতি আমাদের অহংকারের, আমাদের গর্বের। আর এ সংস্কৃতির সিংহভাগই প্রতিফলিত হয় এ যন্ত্রটির মাধ্যমে। আমরা ভাত, মাছ খাই, লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরি, জারি-সারি-ভাটিয়ালি-পল্লীগীতি শুনি, এসবই আমাদের সংস্কৃতির উপাদান; যা আমাদের বাঙালিত্বের পরিচয় বহন করে এবং আমাদের সংস্কৃতির এসব বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করলেই জাতিগত সমস্যা ও সংকটের সৃষ্টি হয়। আমরা যেমন বিদেশিদের মতো বিকিনি পরে চলতে পারব না, তেমনি মাছ-ভাত বাদ দিয়ে সর্বক্ষণ পিৎজা-বার্গার খেয়ে থাকতে পারব না। আমরা সারাক্ষণ চিৎকার বা হুঙ্কার দেওয়া রক গান শুনতে পারব না কিংবা হিন্দি ঢঙের প্রায় অশোভন নৃত্যও দেখতে পারব না। কারণ এগুলো আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না। আমাদের নাটকে যেমন আমাদের সংস্কৃতির প্রতিফলন থাকতে হবে, তেমনি ছোটদের প্রতি আদর-সোহাগ, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি, পারিবারিক সম্পর্ক, পারস্পরিক সৌহার্দ্য মোট কথা আমাদের প্রেম, ভালোবাসা, সম্মান, কৃতজ্ঞতা, মূল্যবোধ সবই নাটকে থাকতে হবে। আর এসব চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজন শক্তিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী। টিভি পর্দায় গুণগত মান না থাকলে দর্শক ধরে রাখা সত্যিই কঠিন। যার প্রতিফলন আমরা এখন দেখছি। নাটক ভালো হওয়ার জন্য ভালো গল্প প্রয়োজন। কিন্তু শুরুতেই যদি দুটি মাত্র চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়ে নাটক চিন্তা করা হয় তাহলে এখনকার ভাষায় সেই ‘আজিব এবং উড়াধুরা প্রেম’ ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না। এখনকার ৯০ শতাংশ নাটকই টিনএজ প্রেমনির্ভর এবং কিছু শিল্পীর ওপর নির্ভরশীল। এ শিল্পী-নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। এ কারণে এখন শিল্পীর নামেও নাটক হচ্ছে। যা হুমায়ূন ফরীদি, আবদুল্লাহ আল মামুন, ফেরদৌসী মজুমদারদের মতো শিল্পীর নামেও কখনো হয়নি। আর আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগের নামে হাসির নাটক বলে যা প্রচার করা হচ্ছে, তা হাসির নয়; হয়ে যাচ্ছে হাস্যকর নাটক। এই আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও নির্মাতাদের আরও সচেতন হতে হবে। কারণ সেখানেও ইদানীং বিকৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যে যেই ভাষা পারে না, তাকে জোর করে সেই ভাষায় অভিনয় করানো হচ্ছে, ফলে বিকৃতি তো হবেই। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাই সে অঞ্চলের মাতৃভাষা। সুতরাং সেই ভাষার বিকৃতি ঘটলে সে অঞ্চলের মানুষের আবেগকে আঘাত করা হয়। শুধু বিকৃতিই নয়, এখন নাটকের গল্প, সংলাপ, দৃশ্যায়ন, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় দক্ষতা, নাটকের অশ্লীল ও অশোভন নাম সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এ কারণেই মানুষের পারিবারিক জীবন বা ফ্যামিলি লাইফ বলে যে কথাটি রয়েছে তাও নষ্ট হতে চলেছে। এত লেখালেখি এবং সমালোচনার পরও একশ্রেণির নির্মাতা এখনো নাটকে ভাষার বিকৃতি করেই চলেছেন। এটি শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও। মনে রাখতে হবে, আমরা এ ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। তাই এ ভাষার বিকৃতি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের সন্তানদের আসলে আমরা কী শেখাতে চাচ্ছি? আমি সব সময়ই বলি, টেলিভিশনের মূলমন্ত্র হচ্ছে তিনটি- তথ্য, শিক্ষা, বিনোদন। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা শুধু বিনোদনের নামে যাচ্ছেতাই অনুষ্ঠান ও নাটক নির্মাণ করে চলেছি। সেখানে আমরা কী তথ্য দিচ্ছি আর কী শিক্ষা পাচ্ছি? এভাবে চলছে বলেই টেলিভিশনের আকার-আকৃতি ও সুবিধা বাড়লেও এর দর্শক বাড়েনি। অর্থাৎ টিভির সাইজ যতই বাড়ুক মানুষকে আকর্ষণ করতে পারছে না। টেলিভিশন হয়ে উঠেছে বিকৃতির আকৃতি। যে কারণে ৩২ থেকে ৮০ পর্যন্ত নানান আকৃতির টেলিভিশন থেকে মানুষ চলে গেছে ৪.৫ ইঞ্চি থেকে ৬.৫ ইঞ্চি আকৃতির যন্ত্রে; যার নাম মোবাইল ফোন। এ ক্ষুদ্র যন্ত্রে আবার হাজার হাজার চ্যানেল; যার নাম ইউটিউব। যেখানে বিষয়ের অভাব নেই আবার বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা নেই। এখানেই এখন মানুষ বিনোদন খুঁজে নেয়। তবে এ ক্ষেত্রেও নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ; যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও ক্ষতিকর। কারণ আমরা এর উপযুক্ত ব্যবহার না করে অপব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অনলাইনের কল্যাণে এখন দেশে অসংখ্য প্রচারমাধ্যম। এর কোনোটা উত্তম, কোনোটা মধ্যম, কোনোটা অধম। বেতার-টিভির সম্প্রচার ছাড়িয়ে অনলাইনের জমপেশ প্রচারে কমবেশি কেউ আলোচিত, কেউ সমালোচিত, কেউ প্রশংসিত। টিভিতে তবু প্রিভিউর ব্যবস্থা আছে কিন্তু এখানে নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ, কোনো সেন্সর। সুতরাং এখনই লাগাম টেনে ধরতে হবে। এখানেও কিছু নীতিমালা প্রয়োজন, যাতে আমরা মিথ্যাচার, অশ্লীল, রুচিহীন এবং সমাজ ও দেশের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো থেকে মুক্ত থাকতে পারি।
চমৎকার কিছু দেখলে মনটা শান্ত হয় কিন্তু চমক কখনো কখনো মনকে অশান্ত করে তোলে। প্রশান্ত মনে টিভি দেখতে বসে অশ্রান্ত চমকের কথা শুনে শ্রান্ত ও অশান্ত হতে চাই না। আমাদের সংস্কৃতি আমাদের অনন্ত অক্ষয় সম্পদ এবং সামাজিকতা আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়। আত্মপরিচয়ের এ অহংকার আমাদের বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। আর সেজন্য মিডিয়ার দায়িত্ব ও গুরুত্ব অপরিসীম।