- আপডেটঃ September, 20, 2023, 2:07 pm
- 403 ভিউ
আরিফ গাজী :
লাভলী আক্তারকে পথে পেলেই ঘিরে ধরেন মায়েরা। জানান নানা সমস্যার কথা। প্রায় সময় পথেই রোগী দেখে পরামর্শ দেন। একসময় প্রত্যন্ত এই এলাকায় প্রসূতিসেবা ছিল না। কোনো নারীর প্রসব বেদনা মানেই ছিল পরিবারে আতঙ্ক। রিকশা কিংবা অটোরিকশার খোঁজে শুরু হতো দৌড়ঝাঁপ। আর রাতের বেলা হলেতো ভোগান্তির শেষ নেই।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অথবা পার্শ্ববর্তী দেবিদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলেও খরচ হচ্ছে অনেক টাকা। তাছাড়া সামান্য সমস্যা হলে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে সিজার করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই সেই পথে পা বাড়াতেন না। গ্রাম্য অদক্ষ ধাত্রীর ওপর মায়েদের ছেড়ে দিতেন পরিবারের সদস্যরা। প্রায় সময় ঘটত বিপদ, কখনো মায়ের, কখনো নবজাতকের। এটাই নিয়তি মেনে নিয়েছিল এখানকার মানুষ।
কিন্তু সেই নিয়তির ধারণা ভেঙে দিয়েছেন একজন নারী। তাঁর নাম লাভলী আক্তার। এলাকার মানুষের সবার পিয় ‘লাভলী আপা’। বিশেষ করে গ্রামের দরিদ্র প্রসূতি মায়েদের ভরসার আরেক নাম ‘লাভলী আপা’। তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ধামঘর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শীকা। তার এই কাজের জন্য বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২২ উপলক্ষে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পরিবার কল্যাণ পরিদর্শীকা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
জানা যায়, উপজেলার ধামঘর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রটি অনেক দিন পূর্বে চালু হলেও এখানে কোন ডেলিভারি হতোনা। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে তিনি এ কেন্দ্র দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে গত চার বছরে তাঁর হাতে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিয়েছে কয়েকশত শিশু। শুধ্ু সন্তান প্রসব নয়, প্রসূতি মা ও নবজাতককে সেবা দিয়ে চলেছেন নিরন্তর। নারীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করতে চারটি স্যাটেলাইট ক্লিনিকে প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছেন মা সমাবেশ। এতে মা ও সন্তানের সঠিক পরিচর্যার পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। জন্ম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিবার ছোট করার জন্য লাভলী আক্তার নারীদের পরামর্শ দিচ্ছেন। ধামঘর ইউনিয়ন তাঁর কর্ম এলাকা হলেও আশেপাশের ইউনিয়নের নারীদেরও সেবা দেন তিনি। এ কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে ৪০-৪৫ জন নারী, পুরুষ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকে।
সিদ্বেশ্বরী গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা মরিয়ম আক্তার বলেন, ‘মাঝরাতে আমার প্রসববেদনা শুরু হয়। এত রাতে কোথায় যাব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মাথায় এল লাভলী আপার কথা। মুঠোফোনে তাঁকে জানালে তিনি দ্রুত আমাকে পরিবার কল্যাণকেন্দ্রে যেতে বলেন। ভালোভাবেই জন্ম নিল আমার মেয়ে। তিনি না থাকলে যে কী হতো, বলে বোঝাতে পারব না।’
পার্শ্ববর্তী দেবিদ্বার উপজেলার রাজামেহের ইউনিয়নের খায়রুল বাসার বলেন, ‘লোকমুখে লাভলী আপার কথা অনেক শুনেছি। আমার স্ত্রীর প্রসবজনিত ব্যথা শুরু হলে দ্রত উনার কাছে নিয়ে যাই। নিরাপদে আমার সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। আমি উনার প্রতি কৃতজ্ঞ।’
সিদ্বেশ্বরী গ্রামের বাসিন্দা কাউছার আহমেদ বলেন, ‘বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা নিলে খরচ পড়ে সব মিলিয়ে ২০-৩০ হাজার টাকা। যা গ্রামের সাধারণ মানুষের পক্ষে অনেক কষ্টকর। কিন্তু লাভলী আপার হাতে সন্তান জন্ম নিলে এক টাকাও খরচ হয় না। উল্টো প্রসব পরবর্তী সেবার জন্য পরিবার কল্যাণকেন্দ্র থেকে বিনা মূল্যে ওষুধপথ্য দেন।’
লাভলী আক্তার বলেন, ‘সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রসূতি নারীরা কেন্দ্রমুখী হচ্ছেন। এখানে যারা আসেন তাদের সকলকে সাধ্যমতো চিকিৎসা দেওয়া হয়। আমি এ কেন্দ্রে যোগদানের পর থেকেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহযোগীতায় গর্ভবতী নারীদের স্বাভাবিক প্রসবের কাজ শুরু করি। প্রতি মাসে এখানে ১০-১৫ জন প্রসূতি নারীর স্বাভাবিক ভাবে বাচ্চা প্রসব করানো হয়ে থাকে। এক মাসে ২৬জন নারীর বাচ্চাও প্রসব করানো হয়েছে এই কেন্দ্রে। এই ইউনিয়ন ছাড়াও আশেপাশের ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকেও প্রসূতি নারীরা বাচ্চা প্রসব করাতে আসেন। শুধু সন্তান প্রসব নয়, প্রসূতি মা ও নবজাতককে সেবা দিচ্ছি। সন্তান হওয়ার পরও নিয়মিত স্বাস্থ্য সেবা ও পরামর্শ পান এখানকার রোগীরা। শুধু প্রসূতি মায়েরা নন, অন্যান্য রোগীরা এখান থেকে পরামর্শ ও ওষুধ নেন। অধিক গুরুতর রোগ ও রোগীর ক্ষেত্রে উপজেলা হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে ২৪ ঘণ্টা গর্ভবতী নারীদের স্বাভাবিক প্রসবের কাজ করানো হয়। যখনই প্রসূতি আসেন তখনই সেবা দেওয়া হয়।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘ধামঘর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রটির সেবা নিয়ে বেশ সুনাম রয়েছে। এ কেন্দ্রে প্রতি মাসে অনেক নারী সন্তান প্রসব করেন। লাভলী আক্তার নিজের মেধা দিয়ে অনেকটা একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন প্রসূতিসেবা।’
আরো পড়ুন....