০১:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫, ২৫ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
কুমিল্লার বেলতলীতে পিকআপ চাপায় পথচারী নিহত বিতর্কের মুখে সংসদের নির্বাচনী এলাকা সীমানা নির্ধারণ কারিগরি কমিটি কুমিল্লা সদর দক্ষিণে জুলাই পুনর্জাগরণে সমাজ গঠনে শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান অপরাধী যে দলেরই হোক, কোনো ছাড় নেই- ওসি মোহাম্মদ সেলিম কুমিল্লা সদর দক্ষিণে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইয়ংস্টার সোশ্যাল অর্গানাইজেশন এর সদর দক্ষিন উপজেলার কমিটি গঠন নতুন পুরাতন বুঝি না,ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে-ডা. শফিকুর রহমান ছয় দফা দাবিতে কুমিল্লা সদর দক্ষিণে স্বাস্থ্য সহকারীদের অবস্থান কর্মসূচি সাবেক সিইসি নূরুল হুদাকে হেনস্তা: স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা হানিফ গ্রেফতার বেপরোয়া বোগদাদ বাসের ধাক্কায় অসহায় ভ্যান চালকের মৃত্যু

বিতর্কের মুখে সংসদের নির্বাচনী এলাকা সীমানা নির্ধারণ কারিগরি কমিটি

  • তারিখ : ০৮:৩০:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫
  • / 870

মনিরুল হক চৌধুরী

অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার কর্মকাণ্ডকে বিতর্ক ও হুমকির মুখে ফেলেছে কারিগরি কমিটি। গত ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের ৩৯টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ পূর্বক খসড়া তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে এই বিতর্কের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। যা ২০০৮ সালের ৪৮টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কুমিল্লা-৯ কে সীমানা নির্ধারণের অজুহাতে বিলুপ্তকরণ। এ সম্পর্কিত কারিগরি কমিটির খসড়া তালিকায় এখন বিষয়টি আবার নতুন করে অনুসরণ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার ও বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়কারী বা প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ড. বদিউল আলম মজুমদার।অথচ ওনার নির্বাচনী এলাকা কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনটিরও সীমানা পুনর্নির্ধারণের পর এখন আন্দোলন সংগ্রাম চলমান। 

জানা গেছে, উনার সঙ্গে কোনো পরামর্শ ছাড়াই কারিগরি কমিটি এই ৩৯টি আসনে সীমানা বিন্যাস পূর্বক খসড়া তালিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। যা এখন বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলন ও সংগ্রামের ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি জানতে ফোন করি ড. বদিউল আলম মজুমদারকে। হয়তো বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তিনি ফোন ধরেননি। তারপর মোবাইলে মেসেজ পাঠালাম। প্রত্যুত্তরে ক্ষুদে বার্তায় তিনি বলেন, ‘The Election Commission set up the technical committee and the reform commissions had no recommendation regarding the names of the members of the technical committee or any interaction whatsoever with its members.’ যা পড়ে হতভম্ব হই।

প্রসঙ্গত, গত ৫ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকারকে সভাপতি করে সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন প্রস্তুতি, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত, তদারকি ও উপকারভোগী পর্যায়ে আলোচনা বিষয়ক কমিটি গঠনের লক্ষ্যে গেজেটের মাধ্যমে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির গত ৮ মাসে বিভিন্ন সংসদীয় এলাকার তৃণমূলের অনেক সুপারিশ, অভিযোগ, প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছেন। যাতে কুমিল্লা জেলার ১১টি আসনের স্থলে ১২টি আসন সম্বলিত একটি রূপরেখা ও চূড়ান্ত প্রস্তাব রয়েছে উক্ত সীমানা নির্ধারণের নির্দেশনায়।

অপ্রিয় হলেও সত্য, উক্ত কমিটিকে পাশ কাটিয়ে গত ১৬ জুলাই এ সংক্রান্ত ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে। যার আহ্বায়ক নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিস্টেম ম্যানেজার (আইসিটি) রফিকুল হক। কমিটির সদস্যদের তালিকায় রয়েছে ভূগোলবিদ, মানচিত্রকর, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিসংখ্যানবিদ প্রমুখ। মূল কমিটিকে পাশ কাটিয়ে তাদের অধীনস্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে কারিগরি কমিটির নামে আরেকটি উপ-কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রশ্নবোধক। এই কমিটির সাথে সংশ্লিষ্টরা নির্বাচনী এলাকা, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে মোটেও অবগত নন। এই কমিটি তড়িঘড়ি করে দুই সপ্তাহের মধ্যে ৩৯টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ ৩০০ আসনের একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করে। যাতে জনসংখ্যার সমতার বিষয়টিকে কিছুটা প্রাধান্য দেয়া হলেও ভৌগলিক ও আইনগত বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়। যা নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
কয়েক মাস পূর্বে কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণের ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দিনের সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করে এর যৌক্তিকতা তুলে ধরি। এ সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম সরকারকেও বিষয়টি লিখিত আকারে জানাই। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কুমিল্লা-৯ আসনটি পুনর্বহালের ব্যাপারে আইনগত একটি ছোট ত্রুটি সংশোধনে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। যা ইতিমধ্যেই আইন মন্ত্রণালয় সংশোধনের মাধ্যমে সুরাহা করে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আনোয়ারুল ইসলাম সরকারের নেতৃত্বে এই সম্পর্কিত কমিটির সুপারিশ ও নির্দেশনা বিষয়টি তথাকথিত কারিগরি কমিটি একেবারেই আমলে নেয়নি। শোনা যাচ্ছে, এই কারিগরি কমিটির মাধ্যমে কুমিল্লা-৯ আসনটিকে লণ্ডভণ্ডের নেপথ্যে একটি অশুভ রাজনৈতিক চক্র ও কুমিল্লার উন্নয়ন বিরোধীরা নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন।

উল্লেখ্য, এ সম্পর্কিত মামলায় মহামান্য হাইকোর্টের-Write Petition No-7132/2013 এর রায় ও Civil Petition for Leave to Appeal No-4607 of 2017 এর আদেশ ও সংশ্লিষ্ট সকল পর্যবেক্ষণ, মন্তব্য, তথ্য ও উপাত্ত, আইনগত ভিত্তি ও নির্বাচন কমিশন ঘোষিত বিভিন্ন সময়ে এ সংক্রান্ত নীতিমালার আলোকে ‘ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক অখণ্ডতা এবং জনসংখ্যা ও ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে’ সাবেক কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকা ‘কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা ও সদর দক্ষিণ উপজেলার সাবেক অংশ বর্তমান কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের ১৯-২৭নম্বর ওয়ার্ড এবং নবগঠিত লালমাই উপজেলা’সহ তথা সাবেক ২৫৬, কুমিল্লা-৯ কে পুনর্বহাল করে ০১টি স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন প্রতিষ্ঠার যুক্তিকতা বিদ্যমান বলে রায়ে উল্লেখ করেন। কিন্তু এসব প্রেক্ষাপট, আইনগতভিত্তি ও আবেদন নিবেদন উপেক্ষা করে কারিগরি কমিটি গত ৩০ জুলাই সাবেক কুমিল্লা-৯ আসনকে তিন ভাগে বিভক্তের অশুভ পরিকল্পনার সূচনা করে। যা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রাণকেন্দ্র কুমিল্লা পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডকে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর আন্দোলন সংগ্রামে অশান্ত, অস্থির, আতঙ্ক ও হুমকির মধ্যে ফেলেছে।

এক্ষেত্রে কুমিল্লা-৯ এর ভৌগোলিক, আঞ্চলিকতা, প্রশাসনিক ও উন্নয়নের স্বার্থে সদর দক্ষিণ ও লালমাই উপজেলাকে অক্ষুণ্ণ রেখে অন্য যেকোনো উপজেলার সাথে সংযুক্তির মাধ্যমে সকল আন্দোলন ও ক্ষোভের অবসানে বিকল্প নেই।
সাবেক কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকার একটি অংশকে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে, লালমাই উপজেলাকে লাকসামের সঙ্গে ও সদর দক্ষিণ উপজেলাকে চৌদ্দগ্রামের সাথে সংযুক্তির ব্যাপারে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘কারিগরি কমিটির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। তালিকাটি তিনি মিডিয়ায় দেখেছেন। তবে কারিগরি কমিটির এই খসড়া তালিকা প্রকাশের পর কুমিল্লা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ব্যাপারে তিনি অবগত আছেন।’

উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাতে প্রতিষ্ঠিত ৫ম উপজেলা কুমিল্লা সদর দক্ষিণ। যা এখন ভেঙে লালমাই উপজেলা সৃষ্টি। ২০০৮ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকার শাসনামলে মাইনাস টু ফর্মুলার পরবর্তী নীলনকশার অংশ হিসেবে বিএনপিকে কোণঠাসার লক্ষ্যে কুমিল্লা-৯ সহ ৫০টি আসনের সীমানা লণ্ডভণ্ড করা হয়। ২০০৮ সালে ১/১১ সরকারের সময় জনৈক নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনের ২/১ জন কর্মকর্তার আক্রোশ ও অসৎ উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র জনসংখ্যার ভিত্তিতে যখন নির্বাচনী এলাকা গঠনের কার্যক্রম গ্রহণ করে তখন খসড়া প্রকাশের সময় কুমিল্লায় ১টি আসন কমিয়ে সাবেক কুমিল্লা-০৯ কে বিলুপ্ত করা হয়। সামছুল হুদা কমিশন প্রণীত সীমানা নির্ধারণ নীতিমালার পরিপন্থী উদ্দেশ্য আক্রোশমূলক ভাবে প্রথমে সাবেক কুমিল্লা-০৯ সদর দক্ষিণ এলাকাকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগ নাঙ্গলকোট উপজেলার সাথে অপর ভাগ বরুড়া উপজেলার সাথে সংযুক্ত করা হয়, অথচ সামছুল হুদা কমিশন নীতিমালা অনুযায়ী বিভক্ত বা বিলুপ্ত হওয়ার কথা ছিল সবচেয়ে ছোট উপজেলা। সেদিক থেকে ছোটর মধ্যে কুমিল্লা-৯ আসনের ক্রমিক হলো ৫ এবং বৃহত্তরের দিক থেকে ক্রমিক ৬ বা ৭।

খসড়া আপত্তির ওপর শুনানির পর এলাকাকে পুনরায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ৩ (তিন) ভাগে বিভক্ত করা হয়। গলিয়ারা ১টি ইউনিয়নকে আদর্শ সদরের অর্থাৎ কুমিল্লা-৬ আসনের সঙ্গে, ৫টি ইউনিয়ন বরুড়া উপজেলার সঙ্গে অর্থাৎ কুমিল্লা-৭ আসনের সঙ্গে এবং বাকি ৬ টি ইউনিয়ন নাঙ্গলকোট উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত করে কুমিল্লা-১০ আসন করা হয়, যা অত্যন্ত নজিরবিহীন। এর ফলে সম্পূর্ণভাবে ছন্নছাড়া হয়ে যায় সাবেক কুমিল্লা-৯ আসনটি। এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের কারণে কুমিল্লা সদর দক্ষিণের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। সাবেক কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকা পুনর্বহালের দাবিতে বহুবার অবস্থান ধর্মঘট, অনশন, রাস্তা অবরোধ করে। নির্বাচন কমিশনের নিকট বারবার স্মারকলিপি প্রদান করে এবং বহুবার আবেদন নিবেদন করেও ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।

তৎকালীন সময়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব সামছুল হুদা কুমিল্লা সদর দক্ষিণের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে আমার স্বপ্নের নির্বাচনী আসনটিকে বিভক্তির বিষয়টি ভুল স্বীকার করে পরবর্তী কমিশনের জন্য তিনি একটি নোট রেখে যান। ২০১১ সালে ‘আদম শুমারির পর’ একইভাবে কাজী রকিব উদ্দিন নির্বাচন কমিশনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। কাজী রকিব উদ্দিন সাহেব এক সময় কুমিল্লার জেলা প্রশাসক থাকার সুবাদে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ ও সাবেক কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকার সমস্যা উপলব্ধি করে পদক্ষেপ নিলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সফল হতে পারেন নি। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শুরুতে নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেন-দরবারের পর বিষয়টি সুরাহার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কুমিল্লায় ১২টি আসন ও কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকার জন্য শুভসংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু এখন কারিগরি কমিটির অসাধু কারিগরিতে আবার অস্তিত্ব হারানোর পথে সাবেক কুমিল্লা-৯ সদর দক্ষিণ-লালমাই আসনটি।


লেখক: জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ ও ক্রীড়া সংগঠক।

শেয়ার করুন

বিতর্কের মুখে সংসদের নির্বাচনী এলাকা সীমানা নির্ধারণ কারিগরি কমিটি

তারিখ : ০৮:৩০:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫

মনিরুল হক চৌধুরী

অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার কর্মকাণ্ডকে বিতর্ক ও হুমকির মুখে ফেলেছে কারিগরি কমিটি। গত ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের ৩৯টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ পূর্বক খসড়া তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে এই বিতর্কের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। যা ২০০৮ সালের ৪৮টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কুমিল্লা-৯ কে সীমানা নির্ধারণের অজুহাতে বিলুপ্তকরণ। এ সম্পর্কিত কারিগরি কমিটির খসড়া তালিকায় এখন বিষয়টি আবার নতুন করে অনুসরণ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার ও বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়কারী বা প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ড. বদিউল আলম মজুমদার।অথচ ওনার নির্বাচনী এলাকা কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনটিরও সীমানা পুনর্নির্ধারণের পর এখন আন্দোলন সংগ্রাম চলমান। 

জানা গেছে, উনার সঙ্গে কোনো পরামর্শ ছাড়াই কারিগরি কমিটি এই ৩৯টি আসনে সীমানা বিন্যাস পূর্বক খসড়া তালিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। যা এখন বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলন ও সংগ্রামের ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি জানতে ফোন করি ড. বদিউল আলম মজুমদারকে। হয়তো বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তিনি ফোন ধরেননি। তারপর মোবাইলে মেসেজ পাঠালাম। প্রত্যুত্তরে ক্ষুদে বার্তায় তিনি বলেন, ‘The Election Commission set up the technical committee and the reform commissions had no recommendation regarding the names of the members of the technical committee or any interaction whatsoever with its members.’ যা পড়ে হতভম্ব হই।

প্রসঙ্গত, গত ৫ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকারকে সভাপতি করে সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন প্রস্তুতি, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত, তদারকি ও উপকারভোগী পর্যায়ে আলোচনা বিষয়ক কমিটি গঠনের লক্ষ্যে গেজেটের মাধ্যমে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির গত ৮ মাসে বিভিন্ন সংসদীয় এলাকার তৃণমূলের অনেক সুপারিশ, অভিযোগ, প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছেন। যাতে কুমিল্লা জেলার ১১টি আসনের স্থলে ১২টি আসন সম্বলিত একটি রূপরেখা ও চূড়ান্ত প্রস্তাব রয়েছে উক্ত সীমানা নির্ধারণের নির্দেশনায়।

অপ্রিয় হলেও সত্য, উক্ত কমিটিকে পাশ কাটিয়ে গত ১৬ জুলাই এ সংক্রান্ত ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে। যার আহ্বায়ক নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিস্টেম ম্যানেজার (আইসিটি) রফিকুল হক। কমিটির সদস্যদের তালিকায় রয়েছে ভূগোলবিদ, মানচিত্রকর, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিসংখ্যানবিদ প্রমুখ। মূল কমিটিকে পাশ কাটিয়ে তাদের অধীনস্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে কারিগরি কমিটির নামে আরেকটি উপ-কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রশ্নবোধক। এই কমিটির সাথে সংশ্লিষ্টরা নির্বাচনী এলাকা, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে মোটেও অবগত নন। এই কমিটি তড়িঘড়ি করে দুই সপ্তাহের মধ্যে ৩৯টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ ৩০০ আসনের একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করে। যাতে জনসংখ্যার সমতার বিষয়টিকে কিছুটা প্রাধান্য দেয়া হলেও ভৌগলিক ও আইনগত বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়। যা নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
কয়েক মাস পূর্বে কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণের ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দিনের সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করে এর যৌক্তিকতা তুলে ধরি। এ সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম সরকারকেও বিষয়টি লিখিত আকারে জানাই। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কুমিল্লা-৯ আসনটি পুনর্বহালের ব্যাপারে আইনগত একটি ছোট ত্রুটি সংশোধনে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। যা ইতিমধ্যেই আইন মন্ত্রণালয় সংশোধনের মাধ্যমে সুরাহা করে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আনোয়ারুল ইসলাম সরকারের নেতৃত্বে এই সম্পর্কিত কমিটির সুপারিশ ও নির্দেশনা বিষয়টি তথাকথিত কারিগরি কমিটি একেবারেই আমলে নেয়নি। শোনা যাচ্ছে, এই কারিগরি কমিটির মাধ্যমে কুমিল্লা-৯ আসনটিকে লণ্ডভণ্ডের নেপথ্যে একটি অশুভ রাজনৈতিক চক্র ও কুমিল্লার উন্নয়ন বিরোধীরা নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন।

উল্লেখ্য, এ সম্পর্কিত মামলায় মহামান্য হাইকোর্টের-Write Petition No-7132/2013 এর রায় ও Civil Petition for Leave to Appeal No-4607 of 2017 এর আদেশ ও সংশ্লিষ্ট সকল পর্যবেক্ষণ, মন্তব্য, তথ্য ও উপাত্ত, আইনগত ভিত্তি ও নির্বাচন কমিশন ঘোষিত বিভিন্ন সময়ে এ সংক্রান্ত নীতিমালার আলোকে ‘ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক অখণ্ডতা এবং জনসংখ্যা ও ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে’ সাবেক কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকা ‘কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা ও সদর দক্ষিণ উপজেলার সাবেক অংশ বর্তমান কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের ১৯-২৭নম্বর ওয়ার্ড এবং নবগঠিত লালমাই উপজেলা’সহ তথা সাবেক ২৫৬, কুমিল্লা-৯ কে পুনর্বহাল করে ০১টি স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন প্রতিষ্ঠার যুক্তিকতা বিদ্যমান বলে রায়ে উল্লেখ করেন। কিন্তু এসব প্রেক্ষাপট, আইনগতভিত্তি ও আবেদন নিবেদন উপেক্ষা করে কারিগরি কমিটি গত ৩০ জুলাই সাবেক কুমিল্লা-৯ আসনকে তিন ভাগে বিভক্তের অশুভ পরিকল্পনার সূচনা করে। যা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রাণকেন্দ্র কুমিল্লা পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডকে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর আন্দোলন সংগ্রামে অশান্ত, অস্থির, আতঙ্ক ও হুমকির মধ্যে ফেলেছে।

এক্ষেত্রে কুমিল্লা-৯ এর ভৌগোলিক, আঞ্চলিকতা, প্রশাসনিক ও উন্নয়নের স্বার্থে সদর দক্ষিণ ও লালমাই উপজেলাকে অক্ষুণ্ণ রেখে অন্য যেকোনো উপজেলার সাথে সংযুক্তির মাধ্যমে সকল আন্দোলন ও ক্ষোভের অবসানে বিকল্প নেই।
সাবেক কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকার একটি অংশকে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে, লালমাই উপজেলাকে লাকসামের সঙ্গে ও সদর দক্ষিণ উপজেলাকে চৌদ্দগ্রামের সাথে সংযুক্তির ব্যাপারে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘কারিগরি কমিটির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। তালিকাটি তিনি মিডিয়ায় দেখেছেন। তবে কারিগরি কমিটির এই খসড়া তালিকা প্রকাশের পর কুমিল্লা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ব্যাপারে তিনি অবগত আছেন।’

উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাতে প্রতিষ্ঠিত ৫ম উপজেলা কুমিল্লা সদর দক্ষিণ। যা এখন ভেঙে লালমাই উপজেলা সৃষ্টি। ২০০৮ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকার শাসনামলে মাইনাস টু ফর্মুলার পরবর্তী নীলনকশার অংশ হিসেবে বিএনপিকে কোণঠাসার লক্ষ্যে কুমিল্লা-৯ সহ ৫০টি আসনের সীমানা লণ্ডভণ্ড করা হয়। ২০০৮ সালে ১/১১ সরকারের সময় জনৈক নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনের ২/১ জন কর্মকর্তার আক্রোশ ও অসৎ উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র জনসংখ্যার ভিত্তিতে যখন নির্বাচনী এলাকা গঠনের কার্যক্রম গ্রহণ করে তখন খসড়া প্রকাশের সময় কুমিল্লায় ১টি আসন কমিয়ে সাবেক কুমিল্লা-০৯ কে বিলুপ্ত করা হয়। সামছুল হুদা কমিশন প্রণীত সীমানা নির্ধারণ নীতিমালার পরিপন্থী উদ্দেশ্য আক্রোশমূলক ভাবে প্রথমে সাবেক কুমিল্লা-০৯ সদর দক্ষিণ এলাকাকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগ নাঙ্গলকোট উপজেলার সাথে অপর ভাগ বরুড়া উপজেলার সাথে সংযুক্ত করা হয়, অথচ সামছুল হুদা কমিশন নীতিমালা অনুযায়ী বিভক্ত বা বিলুপ্ত হওয়ার কথা ছিল সবচেয়ে ছোট উপজেলা। সেদিক থেকে ছোটর মধ্যে কুমিল্লা-৯ আসনের ক্রমিক হলো ৫ এবং বৃহত্তরের দিক থেকে ক্রমিক ৬ বা ৭।

খসড়া আপত্তির ওপর শুনানির পর এলাকাকে পুনরায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ৩ (তিন) ভাগে বিভক্ত করা হয়। গলিয়ারা ১টি ইউনিয়নকে আদর্শ সদরের অর্থাৎ কুমিল্লা-৬ আসনের সঙ্গে, ৫টি ইউনিয়ন বরুড়া উপজেলার সঙ্গে অর্থাৎ কুমিল্লা-৭ আসনের সঙ্গে এবং বাকি ৬ টি ইউনিয়ন নাঙ্গলকোট উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত করে কুমিল্লা-১০ আসন করা হয়, যা অত্যন্ত নজিরবিহীন। এর ফলে সম্পূর্ণভাবে ছন্নছাড়া হয়ে যায় সাবেক কুমিল্লা-৯ আসনটি। এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের কারণে কুমিল্লা সদর দক্ষিণের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। সাবেক কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকা পুনর্বহালের দাবিতে বহুবার অবস্থান ধর্মঘট, অনশন, রাস্তা অবরোধ করে। নির্বাচন কমিশনের নিকট বারবার স্মারকলিপি প্রদান করে এবং বহুবার আবেদন নিবেদন করেও ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।

তৎকালীন সময়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব সামছুল হুদা কুমিল্লা সদর দক্ষিণের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে আমার স্বপ্নের নির্বাচনী আসনটিকে বিভক্তির বিষয়টি ভুল স্বীকার করে পরবর্তী কমিশনের জন্য তিনি একটি নোট রেখে যান। ২০১১ সালে ‘আদম শুমারির পর’ একইভাবে কাজী রকিব উদ্দিন নির্বাচন কমিশনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। কাজী রকিব উদ্দিন সাহেব এক সময় কুমিল্লার জেলা প্রশাসক থাকার সুবাদে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ ও সাবেক কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকার সমস্যা উপলব্ধি করে পদক্ষেপ নিলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সফল হতে পারেন নি। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শুরুতে নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেন-দরবারের পর বিষয়টি সুরাহার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কুমিল্লায় ১২টি আসন ও কুমিল্লা-৯ নির্বাচনী এলাকার জন্য শুভসংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু এখন কারিগরি কমিটির অসাধু কারিগরিতে আবার অস্তিত্ব হারানোর পথে সাবেক কুমিল্লা-৯ সদর দক্ষিণ-লালমাই আসনটি।


লেখক: জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ ও ক্রীড়া সংগঠক।