পৃথিবীর সব সম্পর্কই কেমন যেন কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে। মায়া, মমতা, ভালবাসা সবকিছুই কমে যাচ্ছে। নিজের বাবা-মা, সন্তান কিংবা অতি আপনজন মারা গেলেও সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে হবে। ফেসবুকের প্রতি এত নেশা হবে কেন?
ভাবতেই অবাক লাগে, সবচেয়ে আপনজন মারা গেলে সবার আগে তো আমাদের মন খারাপ হওয়ার কথা। কান্নাকাটি করার কথা। নাওয়া-খাওয়া ভুলে তার জন্য দোয়া করার কথা। মৃত ব্যক্তির আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সুযোগ থাকে না। সেজন্য দুনিয়ার আপন মানুষই তার জন্য দোয়া করবে, যেটা কবরে তার জন্য কাজে আসবে।
আপনার বাবা-মা, সন্তান কিংবা অতি আপনজনের মৃত্যুর খবর মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মীয়-স্বজনরা বিভিন্নভাবে এমনিতেই জেনে যায়। এলাকার মসজিদে ঘোষণা দিয়ে দেয়া হয় কখন জানাজা হবে। তারপরও যদি আপনি মানসিকভাবে খুবই শক্তিশালী হন, তাহলে ফেসবুকে দুই লাইনের একটা স্ট্যাটাস দিয়ে জানিয়ে দিন। মানুষের কাছে দোয়া চান। এর বেশি কি আদৌ করা সম্ভব?
কিন্তু আপনি ২/৩ পৃষ্ঠার সমান বিশাল বড় একটা স্ট্যাটাস লেখা শুরু করে দিলেন। মৃত বাবা, মায়ের লাশের পাশে বসে থেকে মোবাইলে টাইপ করে চলেছেন। এখনো লাশের গোসল দেয়া হয়নি, কবর দেয়া বাকি।
সেই অবস্থায় আপনি লিখে চলেছেন- উনি আপনাদের কিভাবে মানুষ করেছেন, জীবনে কত কষ্ট করেছেন, কত অল্প আয়ে সংসার চালিয়েছেন, দিনরাত কিভাবে পরিশ্রম করেছেন, এক স্যান্ডেল পড়ে তিন বছর চালিয়েছেন, ছিঁড়ে যাওয়া শার্ট সেলাই করে পড়েছেন, ২টি শাড়ি পড়ে তিন ঈদে কোন কাপড় নেই, নিজে কখনো মাছ না খেয়ে আপনাকে খাইয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
স্ট্যাটাস দেয়ার মিনিট দু’য়েক পর থেকে মোবাইলের স্ক্রিনে বারবার আপনি তাকিয়ে থাকছেন। কে লাইক রিঅ্যাক্ট দিল, কে স্যাড রিঅ্যাক্ট দিল, কে কি কমেন্ট করলো সেসব পড়তে আপনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মৃত মানুষটিকে নিয়ে কান্নাকাটি কিংবা দোয়া করার সময় কোথায়? যদিও দ্রুত ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পার্থিব কোন লাভবান হওয়ারও সুযোগ নাই।
আপনার লেখা পড়েই বোঝা যাবে, আপনার বাবা-মা আপনাকে মানুষ করতে অনেক কিছু করেছেন। আপনি কি করেছেন তাদের জন্য? মৃত বাবা-মায়ের লাশের পাশে বসে তাদের জন্য দোয়া করা উচিত ছিল। আপনি যেভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে দোয়া করবেন, আপনার ফেসবুকে স্ট্যাটাস পড়ে, একটা লাইক দিয়ে লোকজন চলে যাবে।
তারা কি দুই রাকাত নামাজ পড়ে আপনার বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করবে? সূরা ফাতিহা, সূরা ইখলাস কিংবা দরুদ শরীফ পড়বে? সম্ভব এটা? আপনি যে স্ট্যাটাস লিখছেন, এটা ১৫ দিন পরেও লিখতে পারবেন। এক মাস পরেও লিখতে পারবেন। কেউ আটকাবে না। এখন লিখলে যেমন মানুষ পড়বে, তখনও পড়বে।
প্রায় নিশ্চিত ধরে রাখুন, আপনি মারা যাওয়ার পরে কেউ আপনার জন্য দোয়া করবে না। আর যদি কেউ করে, তবে সেটা পরম পাওয়া। গ্যাজেট নির্ভর মানুষগুলোর কাছে মৃত্যু সংবাদ তেমন কোন কষ্ট বয়ে আনে না। আর আমরা তো ফেসবুকে বুঁদ হয়ে যাওয়া জাতিতে পরিণত হচ্ছি।
লেখক: রিয়াজুল হক, যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
“যুগান্তর”