আরিফ গাজী :
** প্রতিটি প্রজেক্ট ভরাটে ইউনিয়ন তহসিলদার কে দিতে হয় ১৫-২০ হাজার টাকা।
** নামধারী সাংবাদিকদের কে প্রতি সপ্তাহে দিতে হয় ৫-১০ হাজার টাকা।
** স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রতি প্রজেক্ট ভরাটে দিতে হয় ২০-৩০ হাজার টাকা।
কুমিল্লার মুরাদনগরে কিছুতেই থামছেনা কৃষি জমি থেকে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলন। এতে বিলীন হচ্ছে উপজেলার তিন ফসলি জমি। উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে প্রায় দুই শতাধিক অবৈধ ড্রেজার দিয়ে প্রতিনিয়ত কৃষি জমি থেকে মাটি উত্তোলন করছে স্থানীয় কিছু চক্র। এ বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় অর্ধ শতাধিক জমির মালিক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবর বার বার অভিযোগ করেও নিরুপায় হয়ে তারা এখন ড্রেজার ব্যবসায়ী চক্রের কাছে জিম্মি।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিযানে বের হলে ঘটনাস্থলে পৌছাঁর আগেই খবর চলে যায় ড্রেজার ব্যবসায়ীদের কাছে। যার ফলে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদেরকে পাওয়া যায়না। তবে ব্যবসায়ীদের না পেলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তার অভিযান শেষে অবৈধ ড্রেজার মেশিন জব্দ করে নিয়ে আসার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আবারো সেখানে বসানো হয় অবৈধ ড্রেজার মেশিন। ফলে স্থানীয়দের মুখে এখন একটাই শব্দ অভিযান কি তাহলে শুধুই লোকদেখানো?
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার ৩১২টি গ্রামের মধ্যে প্রায় দু’শতাধিক গ্রামের কোন না কোন স্থানে অবৈধ ড্রেজার মেশিন চলে। মাইলের পর মাইল পাইপ সংযোগ দিয়ে ড্রেজিংয়ের মাটি দিয়ে কোথাও ফসলি জমি আবার কোথাওবা পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। বর্তমানে অবৈধ ড্রেজিংয়ের কারণে ৫০/৬০ ফুট গভীর থেকে মাটি ও বালি উত্তোলনের ফলে আশ-পাশের তিন ফসলের জমিগুলো পরিনত হচ্ছে কূপে।
উপজেলার ছালিয়াকান্দি, বোরারচর, কৃষ্ণপুর, কামাল্লা গ্রামের মোবারক হোসেন, আলফু মিয়া, ইদন ব্যাপারীসহ বেশ কয়েকজন কৃষক বলেন, ড্রেজার বসিয়ে গভীর ভাবে মাটি কাটার কারনে আমাদের তিন ফসলী জমি ড্রেজিং গর্তে বিলীন হয়ে যাচ্চে। কেউ যদি ইচ্ছা করে জমি দিতে না চায়, তাহলে সেখান থেকে জোর পূর্বক মাটি কাটা শুরু করে শেষ পর্যন্ত ড্রেজার মালিকদের নিকট কমমূল্যে জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সাধারণ কৃষক। ড্রেজার সিন্ডিকেটরা জমির মালিকদের বিভিন্ন ভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখে এবং রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভংগায়। ফলে তাদের ভয়ে কেউ কোন অভিযোগ করে না। আর যদিও কেউ অভিযোগ করে প্রশাসনের লোকজন আসার আগেই কিভাবে যেন তারা টের পায়। পরে মেশিনপত্র বন্ধ করে চলে যায়। পরক্ষণে প্রশাসনের লোকজন চলে গেলে তারা আবারো মাটি কাটার উৎসবে মেতে ওঠে। হুনছি সবাই নাকি ভূমি অফিসের লোকজনেরে টাকা দিয়া ড্রেজার চালায়। গণমাধ্যম কর্মীদের নিকট তাদের দু:খের কথা বলতে গিয়ে অনেক কৃষক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ড্রেজার ব্যবসায়ী হারুন মুন্সী বলেন, সবাই মনে করে আমরা ড্রেজার চালাইয়া কতটাকা জানি কামাইতাছি। আসলে এক সময় ঠিকই কামাইতে পারতার। প্রতি প্রজেক্টে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা লাভ হইতো। তখন কাউরে অতো টাকা দিতে হইতো না। এখন ড্রেজার মেশিন বসিয়ে পাইপ লাগানোর সাথে সাথে চলে আসে নায়েব সাব (ইউনিয়ন তহসিলদার) তারে দিতে হয় ১৫-২০ হাজার টাকা। মেশিন চালু করতে না করতে গলায় কার্ড জুলাই হাতে লাঠির কতো একটা মাইক লইয়া হাজির হয়ে পরিচয় দেয় আমি সাংবাদিক টাকা না দিলে শ্রমিকদের মারধর পর্যন্ত করে। তাদের কে প্রতি সপ্তাহে দিতে হয় ৫-১০ হাজার টাকা। আবার অনেকে প্রইভেটকার করে এসে বলে আমি কি ছোট সাংবাদিক হে তোর কি মনে হয়? তাদের কে দিতে হয় বেশি টাকা। এর পর আসে স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যাক্তি তাদের কেউ দিতে হয় টাকা। আবার মাঝে মধ্যে এসিল্যান্ড স্যার আইসা লইয়া জায়গা মেশিন সেটিও নতুন করে কিনে বসাতে হয়। সব মিলিয়ে এখন তেমন একটা লাভ করতে পারি না।
সচেতন মহলের লোকজন বলছে, এইসব অবৈধ ড্রেজারের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় যারা রক্ষক তারাই ভক্ষক এর ভূমিকায়। এখানে বড় একটি প্রশ্ন থেকেই যায় প্রশাসন এতো এতো অভিযান পরিচালনা করছেন অথচ মূলহুতারা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। ফলে তারা দিন দিন অপরাধ করতে ভয় পাচ্ছে না।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমান ২৪ হাজার ২৯৩ হেক্টর। এর মধ্যে বেশীর ভাগই দুই থেকে তিন ফসলী জমি। অথচ সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত অনাবাদী রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন আহম্মেদ সোহাগ বলেন, আমি উদ্ধিগ্ন ও আতংকিত। কেননা তিন ফসলি জমির টপসয়েল্ট (উর্ভর মাটির উপরের অংশ) ব্যাপক হারে কেটে নিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে চাষাবাদের জন্য একখন্ড জমি থাকবে না। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কড়া ভাবে নিষেধাজ্ঞা আছে জমির মাটি কেটে নিয়ে অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
মুরাদনগর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ নাজমূল হুদা বলেন, ভূমি অফিসের কোন কর্মকর্তা ড্রেজার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এ বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি কারও বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগ পাই, তাহলে অবশ্যই ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমি আসার পরে এখন পর্যন্ত যেখান থেকেই ড্রেজারের অভিযোগ এসেছে সেখানেই অভিযান পরিচালনা করেছি। এটি বন্ধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে তাহলেই হয়তো সম্ভব। আর অবৈধ ড্রেজার বন্ধে আমাদের অভিযান সবসময় অব্যাহত আছে।
এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অভিষেক দাশ বলেন, এসব অবৈধ ড্রেজার নির্মূল করতে হলে প্রথমে আমাদের সকলকে আন্তরিক হতে হবে। প্রত্যেকটি জায়গা থেকে সকলকে সহযোগীতা করতে হবে। তাহলে এটি বন্ধ করা সম্ভব। তবে এখন পর্যন্ত যেখান থেকেই ড্রেজারের অভিযোগ এসেছে সেখানেই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আর অবৈধ ড্রেজার বন্ধে আমাদের অভিযান সবসময় অব্যাহত আছে।