মাহফুজ নান্টু :
করোনায় বিপর্যস্ত চারপাশ। স্থবির হয়ে আছে জনজীবন। তার মাঝে চলছে পবিত্র মাহে রমজান। এমন প্রতিকূল পরিবেশের মাঝেও থেমে নেই রক্তদান। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জাগ্রত মানবিকতা। এ সংগঠনের সদস্যরা করোনা ও রমজান মাসেও রক্তদাতা নিয়ে হাজির হচ্ছেন হাসপাতালের কেবিনে। রক্ত যোগাড় নিয়ে দূঃচিন্তায় মগ্ন থাকা রোগীর স্বজনদের চিন্তামুক্ত করছেন। রোগী ও তাদের স্বজনদের কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিচ্ছেন। রক্তদান শেষ হলে রক্তদাতারা মানুষের সেবার তৃপ্তি নিয়ে হাসি মুখে বাড়ী ফিরেন।
জানা যায়, করোনায় লকডাউনের সময় অন্তত ১০২ জন অসুস্থ রোগী এবং প্রসূতীর মাঝে রক্ত দেন জাগ্রত মানবিকতার সদস্যরা। তবে লকডাউনের এমন জরুরী সময়ে এই শতাধিক মানুষের জন্য রক্ত দেয়াটা মোটেই সুখকর ছিলো না। রীতিমত চ্যালেঞ্জিং অবস্থায় রক্ত যোগাড় করতে হয় তাদের। ঠিক এমনই এক অভিজ্ঞতার কথা জানালে জাগ্রত মানবিকতার কো-অর্ডিনেটর আশরাফ আলী।
গত ২০এপ্রিল। করোনায় লকডাউন চারদিকে। যানবাহন বন্ধ। রাত সাড়ে ১১ টা। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক প্রসূতীর সিজারের পর রক্তপাত শুরু হয়। জরুরী ভিত্তিতে ওই নারীর এবি পজেটিভ রক্ত প্রয়োজন। জানানো হয় জাগ্রত মানবিকতাকে। খুব দ্রুত ডোনার নিয়ে হাজির হন জাগ্রত মানবিকতার কো-অর্ডিনেটর আশরাফ আলী। পরে যে ডোনারকে নিয়ে যাওয়া হলো দেখা গেলো তার রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ। এখন কি করা? এদিকে রোগীর অবস্থা আশংকাজনক। কো-অর্ডিনেটর আশরাফ আলী আবারো রক্তে জন্য বের হলেন। চারদিকে শুনসান নিরবতা। তার মাঝেই আবারো এবি পজেটিভ গ্রুপের ডোনার নিয়ে হাজির হলেন। রক্ত দেয়া হলো রোগীকে। রোগী কিছুটা সুস্থ হলেন। তারপর রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হলো ঢাকায়। কিছু দিন চিকিৎসা শেষে বেঁচে ফিরলেন রোগী। স্বস্তির হাসি দেখা গেলো কো-অর্ডিনেটর আশরাফের মুখে।
রমজান ও করোনা লকডাউনে জাগ্রত মানবিকতার সদস্য সাইফুল ইসলাম অপু , রাসেদ আহাম্মেদ তামিম , রাজিবুর রহমান সাগর, জাহিদুল ইসলাম বাবু , আকরাম সামি , বাসার , মোশারফ মজুমদার মুন, হাবীবুল্লাহ চৌধুরী রুমি , আশরাফ আলী, ফয়সাল আলম তানভীর , সৈয়দ তানভীর হোসেন , তানিম, সাকিবুল ইসলাম শুভ , সাহেল সাজিদ , নজরুল ইসলাম জনি-, রেজাউল করিম সৌরভ , মতিউর রহমান মিঠু , সুজিত কুমার দাস, ফয়েজ আহাম্মেদ সাকিল, সাগর আহাম্মেদ, স্বপন, মনিরুজ্জামান পিয়াস, আদনান রকি, রিয়াদ, মো: বাপ্পি রাজ,এমকে কাইয়ুম হাসান, স্বপ্নিল তুহিনরা সব সময় প্রস্তুত থাকেন।
রক্তদানের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকেন। যদি তারা নিজেরা অসমর্থ হন তারা জাগ্রত মানবিকতার ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে পোস্ট করেন। সংগঠনের সদস্যরা একে অপরের সাথে শেয়ার করেন। ডোনার জোগাড় করেন। কিংবা নিজেরা প্রস্তুত হয়। আর এভাবে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে রক্ত জোগাড় হয়। বেঁচে যায় রোগীর প্রান। হাসিফুটে রোগীর স্বজনদের মুখে। প্রতিটি রক্তদানের নেপথ্যর গল্পটা এমনই।
গত ১৫ রমজান। ইফতারের পর থেকেই জাগ্রত মানবিকতার সদস্য সাকিবকে নিয়ে মেডিকেল যায় জাগ্রত মানবিকতার কো-অর্ডিনেটর কায়সার জামান কায়েস। কাজ শেষে ক্লান্ত- শ্রান্ত কায়সার বাসার অভিমুখে রওনা হয়। ঠিক সেই সময় খবর এলো জরুরী ভিত্তিতে সুরাইয়া আক্তার নামে এক মায়ের ‘সি-সেকশনের জন্য রক্তের প্রয়োজন। আবার নিজের ক্লান্তি ভুলে ছুটে যায় জাগ্রত ফেরিয়ালা কাউছার ! অচেনা অজানা মানুষের পাশে দাঁড়াতে। রক্ত দেন কাউছার।
জরুরী মুহূর্তে রক্তদান ছাড়াও কিছু রোগীর জন্য প্রতিমাসে রক্ত জোগাড় করে রাখতে হয় জাগ্রত মানবিকতার সদস্যদের। এমনই একজন রোগী কিশোরী উর্মি। বাড়ী আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউনিয়নের মাঝিগাছা শ্রীপুরে। উর্মি দীর্ঘদিন ধরে থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য তার প্রতি মাসে রক্ত লাগে। রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ। গত দু’ বছর ধরে জাগ্রত মানবিকতা অসুস্থ উর্মির জন্য প্রতি মাসে এক ব্যাগ এ পজেটিভ রক্ত জোগাড় রাখে। যা দিয়ে উর্মির চিকিৎসা হচ্ছে।এভাবেই জাগ্রত মানবিকতা এখন কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে আস্থা ও বিশ্বাসের সংগঠন হয়ে উঠেছে।
কথা হয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জাগ্রত মানবিকতার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তাহসিন বাহার সূচনা’র সাথে। তিনি জানালেন, সংগঠনটির শুরু থেকে আর্তমানবতার জন্য কাজ করছে। তার পাশাপাশি সংগঠনটি রক্ত নিয়ে কাজ করে। সংগঠনটি শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ৪৫০০ জনেরও অধিক রোগীকে রক্ত দিয়েছেন। এখন করোনা লকডাউন চলছে। এমন মুহূর্তে জরুরী রক্ত পাওয়া দুষ্কর।অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাগ্রত মানবিকতার সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রক্ত জোগাড় করছে। তাহসিন বাহার সূচনা আরো জানান, তিনি আমৃত্যু মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চান। তবে সে জন্য নেপথ্যর জাগ্রত মানবিকতার স্বেচ্ছাসেবক-ডোনারদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাদের ওই সব স্বেচ্ছাসেবক-ভলেন্টিয়ারদের সহযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে জাগ্রত মানবিকতা।