সৌদি আরবে ফিরতে টিকিটের জন্য বৃহস্পতিবারও ভোর থেকে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের সামনে প্রবাসীদের ভিড় দেখা গেছে।
সোনারগাঁও হোটেলে থাকা সৌদি এয়ারলাইনসের কার্যালয়ের সামনের ফটকে জড়ো হন টিকিটপ্রত্যাশীরা। আজ কেউ সড়কে দাঁড়িয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। কাজেই যান চলাচলও ব্যাহত হয়নি বলে দেখা গেছে।
সকালে পুলিশের তরফে টিকিটপ্রত্যাশীদের উদ্দেশে মাইকে জানানো হয়, আজ এক থেকে ৫০০ নম্বর টোকেনধারীদের টিকিট দেয়া হবে। শুক্রবার ৫০১ থেকে ৮৫০, শনিবার ৮৫১ থেকে ১২০০, রোববার ১২০১ থেকে ১৫০০ নম্বর টোকেনধারীদের টিকিট দেয়া হবে। যারা টোকেন পাননি, তাদের ২৯ সেপ্টেম্বর আসতে বলা হয়েছে।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিজি) রুবায়েত জামান গণমাধ্যমকে এই তথ্য জানান। তবে প্রবাসী টিকিটপ্রত্যাশীদের কারও কারও অভিযোগ, এ পর্যন্ত এক থেকে ২০০ জনকে টোকেন দেয়া হয়েছে।
সোলায়মান নামের এক সৌদিপ্রবাসী বলেন, এত টোকেন কীভাবে যোগ হলো? ৫০০ জনের পর কী ব্যবস্থা নেয়া হবে? আমদের ফ্লাইটের ব্যাপারে কী করা হবে?
এদিকে বাংলাদেশি প্রবাসীদের ইকামার মেয়াদ ২৪ দিন বাড়িয়েছে সৌদি সরকার। পাশাপাশি বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্স-দুটোকেই বাংলাদেশ থেকে যাত্রী আনা-নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে, তাদের মেয়াদ বাড়ানো হবে।
বুধবার রাতে যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, বুধবার ছিল হিজরি সফর মাসের ৬ তারিখ।
এই মাসে প্রবাসীদের যারা যাবেন, তাদের সবার ইকামার মেয়াদ বাড়িয়ে দেবে সৌদি সরকার। সে হিসাবে আরও ২৪ দিন সময় পাবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশিদের ফ্লাইট জটিলতা নিরসন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অন্যান্য ইস্যু নিয়ে রোববার ভার্চুয়াল বৈঠকে বসছেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফায়সাল বিন ফারহান আল-সৌদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।
কূটনৈতিক সূত্র কে জানিয়েছে, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী। তার আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতেই ওই টেলিকনফারেন্সের আয়োজন করছে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ভ্রাতৃপ্রতিম দুই রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ওই আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বার্নিং ইস্যুগুলোর স্টক টেকিং হওয়া ছাড়াও সমসাময়িক বিষয়াদি নিয়ে কথা হবে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রোববার থেকে ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাস খুলবে। এছাড়া ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিমানকে চারটি বিশেষ ফ্লাইটের অনুমতিও দেয়া হয়েছে।
রাতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার নিজস্ব ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, সৌদি আরবে চারদিন বর্ধিত ছুটি ছিল। বুধবারই সব অফিস খুলেছে। সৌদি আরবের যারা খোঁজ রাখেন, তাদের এটা জানা উচিত।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও লেখেন, সৌদি সরকার আমাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ৪টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। এগুলো হল-ইকামার মেয়াদ আরবি সফর মাসের শেষদিন পর্যন্ত বর্ধিতকরণ।
বাংলাদেশ বিমানকে রিয়াদ ও জেদ্দায় সপ্তাহে মোট চারটি ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয়েছে। ঢাকাস্থ সৌদি আরব দূতাবাসের ভিসা অফিস রোববার থেকে খোলা থাকবে। যেখানে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নতুন নিয়মাবলি মেনে কনসুলার সেবা দেয়া হবে।
এর আগে দেশে আটকেপড়াদের জন্য মোট তিন দফায় বাংলাদেশিদের ইকামার মেয়াদ বাড়িয়েছে সৌদি সরকার। করোনার কারণে মার্চের শেষের দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো সৌদির সঙ্গেও সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়।
এতে ছুটিতে দেশে আসা অনেক প্রবাসী কর্মী ঠিক সময়ে আর ফিরতে পারেননি। এর মধ্যে হঠাৎ করেই সৌদি সরকার ঘোষণা দেয়, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সৌদি আরবে ফিরতে হবে কর্মীদের।
এ অবস্থায় কয়েক দিন ধরে বিমানের টিকিট এবং ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ করছেন দেশে আটকেপড়া প্রবাসীরা। বুধবার তারা সৌদি এয়ারলাইন্সের অফিসের সামনে ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসীকল্যাণ এবং পররাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বৈঠকে বসে।
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, এ ধরনের বিক্ষোভ বা আন্দোলন করলে সৌদি আরবের কাছে ভুল বার্তা যাবে। সৌদি আরবে ফিরে যেতে ইচ্ছুক প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিশৃঙ্খলা না করে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তিনি।
জানা গেছে, করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে দেশে ছুটিতে এসে আটকেপড়া বাংলাদেশিদের জন্য ইকামা কিংবা ভিসার মেয়াদ আরও তিন মাস বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে মঙ্গলবার সৌদি সরকারকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ।
সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই চিঠি দেয় দেশটিতে বাংলাদেশ দূতাবাস। চিঠিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের ইকামা কিংবা ভিসা- যার যেটা প্রয়োজন সেই অনুযায়ী মেয়াদ তিন মাস বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়। বুধবার ইকামার মেয়াদ ২৪ দিন বাড়ানোর কথা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে জানাল সৌদি সরকার।
সৌদিতে বিমানের বিশেষ দুই ফ্লাইট : সৌদি ফেরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বাংলাদেশ বিমান দুইটি বিশেষ ফ্লাইট ঘোষণা করেছে। ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর এই ফ্লাইট দুটি পরিচালনা করবে।
বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বিমানের এমডি মোকাব্বির হোসেন জানান, বাংলাদেশ বিমানের যেসব যাত্রী ১৬ ও ১৭ মার্চের জেদ্দা ও রিয়াদের বিমানের রিটার্ন টিকিট কেটেছিলেন, তাদের ২৬ সেপ্টেম্বর (ঢাকা-জেদ্দা) ও ২৭ সেপ্টেম্বর (ঢাকা-রিয়াদে) যাত্রীবাহী ফ্লাইটে সৌদি আরব নিয়ে যাওয়া হবে।
এর আগে বিমানের বেশ কয়েকটি বিশেষ ফ্লাইট সৌদি গেলেও সেখানে যাত্রী নেয়া হয়েছিল নিবন্ধন এবং ‘আগে এলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে। এবারই প্রথম রিটার্ন টিকিট কাটা যাত্রীদের অগ্রাধিকার দেয়া হল।
বিমান জানায়, ১৬ ও ১৭ মার্চের ফিরতি টিকেটধারী যাত্রীদের এই ফ্লাইটে বুকিংয়ের জন্য বিমান সেলস অফিসে টিকিট, পাসপোর্ট, সৌদি আরব নির্ধারিত অ্যাপ/লিংক থেকে অনুমোদন ইত্যাদিসহ আগামীকাল ২৪ সেপ্টেম্বর (আজ) যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
বিমান আরও জানায়, নতুন ফ্লাইট অনুমোদন সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে অন্য যাত্রীদেরও বুকিংয়ের জন্য অবহিত করা হবে। তবে অন্য তারিখের যাত্রীদের এখনই অযথা কাউন্টারে ভিড় না করতে অনুরোধ করছে তারা।
এদিকে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছেন, ইচ্ছেমতো ফ্লাইট পরিচালনায় বাধা নেই সৌদি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের। তিনি বলেন, সরকার বিমানকে সৌদিতে ফ্লাইট পরিচালনা করতে না দিলেও সৌদি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে সমস্যা নেই।
জানা গেছে, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সের অফিসে শনিবার থেকেই টিকিটের জন্য ঘুরছেন প্রবাসীরা। তাদের অভিযোগ, লাইনে দাঁড়ালেও টিকিট দিচ্ছে না সাউদিয়া। রিটার্ন টিকিট থাকার পরও অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা রিইস্যু করতে নিচ্ছে এয়ারলাইন্সটি। একই সঙ্গে টিকিট বিক্রি করছে ৯৫ হাজার টাকায়।
বুধবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কারওয়ান বাজার সৌদি এয়ারলাইন্স কার্যালয় ঘিরে সকাল থেকেই প্রবাসীরা অবস্থান করছেন। টিকিট না পেয়ে কয়েক দিন ধরেই মতিঝিলে বিমান অফিসের সামনেও বিক্ষোভ করে আসছেন সৌদি প্রবাসীরা।
বুধবার বেলা ১১টার দিকে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের পরে আরেকটি দল বেলা ১২টার দিকে মতিঝিল থেকে মিছিল নিয়ে প্রেস ক্লাব হয়ে সেই ঘেরাও কর্মসূচিতে যোগ দেয়।
এ বিষয়ে রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম জানান, দলে দলে তারা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সামনে এসে জড়ো হয়।
বিক্ষোভ মিছিল করেছে; কিন্তু কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেনি তারা। পরে তাদের থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করে সচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে তারা জেনেছেন।
প্রবাসী তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, তারা লিখিত বক্তব্য তৈরি করেছেন। তাদের দাবি হল- ইকামার ও ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয় দাবি হচ্ছে-তাদের অনেকেই রিটার্ন টিকিট নিয়ে এসেছে।
তারা যেন সেই টিকিটে ফিরে যেতে পারে। তৃতীয় দাবি হচ্ছে-তাদের টিকিটের মূল্য যেন বেশি রাখা না হয়। অন্যান্য এয়ারলাইন্স যেন হয়রানি না করে।’ তিনি আরও জানান, ‘প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়, সেজন্য তারা এসেছেন।
পরে তিনিসহ একটি প্রতিনিধি দল দুপুরের দিকে মন্ত্রী সচিব ও প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করে। বেলা ১টার দিকে আলোচনা শেষে প্রতিনিধি দলটি বেরিয়ে আসে।
বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, চলতি মাসে ৪টি ফ্লাইটে ১ হাজার ৬০টি টিকিট ছিল। সব বিক্রি হয়ে গেছে। সৌদি আরবে ল্যান্ডিং অনুমতি পেলে ১ অক্টোবর থেকে সৌদি আরবে তারা সপ্তাহে আটটি ফ্লাইট পরিচালনা করবে। তখন প্রবাসীদের পাঠানো যাবে।
বিক্ষুব্ধকারীরা জানান, প্রবাসীদের মধ্যে অধিকাংশ মার্চের শুরুতে দেশে এসেছিলেন। কেউ কেউ এর আগেও ছুটিতে এসেছেন। কিন্তু করোনার কারণে তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত যেতে পারেননি।
কারও চাকরি, কারও আবার নিজস্ব ব্যবসা রয়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রবাসীদের অনেকে বলেছেন, এত প্রবাসীদের কী করে পাঠানো যাবে, এটি তো সরকার দ্রুততার সঙ্গে দেখবে- আমাদের পাঠানো নিশ্চিত করবে।
প্রবাসী নাজমুল, সিরাজুল ইসলাম, হিরণ মিয়া, সুলতান খানসহ প্রায় ২০ জন প্রবাসী জানান, প্রবাসীদের মধ্যে অধিকাংশই রিটার্ন টিকিট কাটা। রিটার্ন টিকিট কাটা থাকলেও তাদের কাছ থেকে বেশি টাকা চাওয়া হচ্ছে।
বরিশাল থেকে আসা দুই ভাই সোহেল ও জাবের জানান, তারা ফেব্রুয়ারিতে ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। রিটার্ন টিকিট কাটা। শনিবার এসেছেন- টোকেন পেয়েছেন ১৭৮-১৯৮ নম্বর।
চারদিন আগে টিকিটের টোকেন পেলেও এখন পর্যন্ত কোনো খবর নেই। এদিকে চার দিন আগে আসা অনেক প্রবাসী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
রোববার স্থানীয় হোটেল কর্তৃপক্ষ একটি কলা ও রুটি সকালে নাশতার জন্য দিলেও বুধবার পর্যন্ত কেউ এক বোতল পানিও দেয়নি।
ক্লান্ত প্রবাসীদের মধ্যে কেউ বসে আছেন, কেউবা শুইয়ে আছেন। আর যারা বাইরে রয়েছেন, তারা রোদ-বৃষ্টিতে পুড়ছেন।
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ সোহেল বলছিলেন, শনিবার তিনি এসেছেন। কেউ কিছু বলছে না, টিকিট পাবেন কি না পাবেন না। হাতে টাকাও নেই।
এক প্রকার না খেয়ে আছেন। মঙ্গলবার তার মেয়ে মারা গেছে জানিয়ে বললেন, সৌদিতে ফিরে না যেতে পারলে না খেয়ে মরতে হবে। মেয়ে মরে গেছে, তবু এখান থেকে যেতে পারেননি। আশা, তিনি টিকিট পাবেন।