কালের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর দূরদৃষ্টি, নেতৃত্ব, মানবিকতা এবং আত্মত্যাগই ‘সোনার বাংলা’ গঠনের স্বপ্নের সৃষ্টি। আজ বাংলাদেশ সেই স্বপ্ন পূরণের পথে অগ্রগামী দেখে যারপরনাই খুশি আমরা। মুজিবুর রহমান সম্পর্কে একটি প্রবন্ধে পড়েছিলাম, হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে তিনি নক্ষত্রের অক্ষরে রচিত একটি নাম; যা নিজ আলোতেই ভাস্বর হয়ে থাকবে। তিনি এক অসাম্প্রদায়িক আদর্শের প্রবর্তক। যা আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতেই লিখেছেন, সেই সময়ের প্রধান নেতাদের উল্লেখ করেছিলেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্যের কথা। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ আজকের দিনে অন্যতম পাথেয় হওয়া উচিত সব সমাজ নেতাদের কাছে।
মুজিবুর রহমানের বিশাল কর্মময় জীবনের সামগ্রিক মূল্যায়ন করাটা নিঃসন্দেহে দুরূহ কাজ। কিন্তু বর্তমান সময়ের গবেষকদের কাছে তাঁর জীবনগাথার এক সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ প্রয়োজন রয়েছে। ধৈর্য, তীব্র মানসিকতা, দৃঢ়তা ও আত্মসংযমের এক প্রতীক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহুবিধ গবেষণা চলছে। আগামী দিনেও চলবে। কিন্তু তাঁকে চিনতে গেলে তাঁরই এক মন্তব্য অনুধাবন করা উচিত। তিনি নিজেই লিখেছিলেন, “একজন মানুষ হিসেবে আমি সমগ্র মানব জাতি নিয়েই ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং আমার অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে একটাই মিল খুঁজে পাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই এঁদের হত্যা করা হয়। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী যেমন নিহত হলেন, তেমনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। বর্মার অং সান এবং শ্রীলঙ্কার রানাসিংহে প্রেমাদাসও নিহত হন। কিন্তু এসব হত্যাকান্ডের প্রকৃত সামাজিক, রাজনৈতিক অথবা আর্থিক কারণগুলো সম্পর্কে প্রত্যেক দেশবাসীর অবহিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কেবলমাত্র নিরাপত্তা সংস্থার দ্বারা তদন্ত নয়। সমাজতত্ত্ববিদদের সামাজিক কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। সেই সত্য উদঘাটন হলে সামাজিক বিদ্বেষের উৎসস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে। মানুষকে কতটা বিভ্রান্ত করলে সে অমানবিক আচরণ করতে পারে বা ঘৃণা-বিদ্বেষের আদর্শের শিকার হয়, বঙ্গবন্ধুর অসময়ে হত্যা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে নিঃসন্দেহে বিশাল আঘাত। সেখান থেকে বাংলাদেশের উত্থান ঘটিয়ে আজ উন্নয়নের মডেলে পৌঁছে দেওয়া এক কৃতিত্বের পরিচায়ক।
আমার বর্তমান বাসভবন ১০ নম্বর রাজাজি মার্গ। সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামও অবসর নেওয়ার পর এই বাংলোয় থাকতেন। রাজধানী দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন, নর্থ ও সাউথ ব্লকের নির্মাতা ব্রিটিশ স্থপতি এডওয়ার্ড টিয়েন এ বাংলোতেই বাস করতেন। দোতলা বাংলোর একতলায় বসার ঘর, সেখানকার বড় কাঠের টেবিলটা দেখলে আরেকটা টেবিলের কথা মনে পড়ে। আমি যখন প্রথম অর্থমন্ত্রী হই, তখন আমার টেবিলটা ছিল অতিকায়। এ টেবিলের একটা ইতিহাস আছে। ভারতের প্রথম অর্থমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ টেবিলে বসতেন। পরে তিনি পাকিস্তান চলে যান। শুনেছি, ভারত ভাগ হওয়ার সময় তার পূর্বাভাস ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানকে বোধহয় বেশি দিন একত্রে রাখা যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে পূর্বাভাস সত্যে রূপান্তর করেছিলেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বাঙালিত্ব কখনো ভুলতে পারি না। রাইসিনা হিলসের রাষ্ট্রপতি ভবনে এই প্রথম একটি বাংলা বইয়ের গ্রন্থাগার তাই গড়ে উঠেছে আমার আমলে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বহু পুস্তক রয়েছে। এ গ্রন্থাগারে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। আমার কাছে মনে হয়, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হলে এ গ্রন্থটি একমাত্র প্রামাণ্য দলিল। আজও আমি বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হই, বাঙালি হিসেবে তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আসলে নিজের জাতিসত্তা সম্পর্কে গর্ববোধ না থাকলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। সেটিই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে নেওয়া আমার প্রথম শিক্ষা।
অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে আমি যতটুকু জানি, তার চেয়ে অনেক বেশি জানতেন রাজনীতিতে আমার আদর্শ ইন্দিরা গান্ধী। মনে আছে, ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে একবার সতর্ক করেছিলেন জীবন-সংশয় নিয়ে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল- ‘ওরা আমারই সন্তান। আমাকে কেন হত্যা করবে?’ অথচ সেই সেনাবাহিনীর একাংশের হাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। এরই মধ্যে তাঁর হত্যাকান্ডের বিচারও হয়েছে। কিন্তু আমার মনে এখনো সন্দেহ রয়েছে, হত্যার ষড়যন্ত্র কতটা উদঘাটন করা গেছে। সাধারণভাবে হত্যাকারী কারা এখন আমরা সবাই জানি। কিন্তু তাঁর হত্যাকান্ডের পেছনের ষড়যন্ত্র নিয়ে প্রকৃত তদন্ত আজও সমাপ্ত হয়নি। প্রকৃত রহস্য এখনো উদঘাটন হয়নি।
আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলাদেশকে সৃষ্টি করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কেননা, তিনি অত্যন্ত উদার নীতির প্রবর্তক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি লাহোর যান। পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন ও স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তার অবশ্য মূল কারণ ছিল- যেসব বাঙালি তখনো পাকিস্তানে রয়ে গিয়েছিলেন, তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যই ছিল প্রধান। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিল জোটনিরপেক্ষ। পাকিস্তানবিরোধী বলেই ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় প্রথম কয়েকটি দেশের মধ্যে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মিসরের পক্ষ নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর কথা মনে হলে আমার প্রথমেই মনে পড়ে তাঁর ভাষণের কথা। আমি বলতে পারি, এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এশিয়ার শ্রেষ্ঠ জননেতা। তাঁর বাগ্মিতার তুলনা মেলা ভার। পরে তিনি এশিয়ার গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক নেতা হয়ে উঠেছিলেন। এশিয়ার দুর্ভাগ্য যে, এ ধরনের মহান রাষ্ট্রনেতাদের অকালেই প্রাণ হারাতে হয়। বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বন্দরানায়েক-এঁরা জীবিত থাকলে আজ এশিয়ার চেহারা অন্যরকম হতো। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এ ধরনের রাষ্ট্রনেতাদের আজ বড়ই অভাব।
যেদিন তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হয় সেদিন আমি দিল্লিতে ছিলাম না; কলকাতায় ছিলাম। আকাশবাণীর সংবাদে খবরটা জানার পর আমি বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারিনি। স্বজন হারানোর মতো শোকাহত হয়েছিলাম। পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ফোন পেয়ে দিল্লি ছুটে যাই। মনে হয়েছিল যে, অশুভ শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তারা হয়তো সেখানেই থেমে থাকবে না। নবসৃষ্ট বাংলাদেশকে ফের অন্ধকারের রাজত্বে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তাই ভারত সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। আমাদের সৌভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা-রেহানা সেদিন ঢাকায় ছিলেন না। তাই আজ বাংলাদেশ ফের মুজিব আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে। আমি বলি, ‘মুজিবইজম’। সেটিই তাঁর দর্শন; বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি।
বলে রাখি, প্রথম থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি লন্ডন থেকে দিল্লি আসেন, তখন প্রথম সম্মুখ সাক্ষাৎ। দীর্ঘদেহী ও বজ্রকণ্ঠের মানুষটিকে দেখে শ্রদ্ধায় মন ভরে গিয়েছিল। অনেক কথা হয়েছিল। তখন আমাকে দেখিয়ে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন- ‘এ মানুষটির নাম প্রণব, আপনাদের জন্য বিশ্বের সমর্থন আদায় করার লক্ষ্যে ছুটে গিয়েছিলেন। ওর জন্যই আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে আমার অনেক সুবিধা হয়েছে।’ সে সময় বঙ্গবন্ধুর মুখে আমার সম্পর্কে ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ শুনে আমি কিছুটা লজ্জিত হয়েছিলাম।
সত্তর দশকে আমরা দেখেছি, বিশ্বজুড়ে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের নাম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গোটা বিশ্বে নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের কাছে আদর্শ। আমার মননকে সব সময়ই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আলোড়িত করে। ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, প্রথম বিদেশ সফর হবে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। তবে আবার একবার বাংলাদেশ যাওয়ার ইচ্ছা রয়ে গেছে। এবার যাব ভারতের সাধারণ নাগরিক হিসেবে; একজন বাঙালি হিসেবে।