কথা দিয়ে রাখছেন না চিনি আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। রমজানে বিপুল মজুদ রয়েছে এবং দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই বলে সরকারকে আশ্বস্ত করার দেড় সপ্তাহের মধ্যেই লাগামহীন বাড়িয়ে চলেছেন পণ্যটির দাম। অথচ এখনো রমজান আসতে অনেক দেরি। কয়েক সপ্তাহ আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদনে রমজান ঘিরে পণ্যটির দাম বাড়াতে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সক্রিয় হবে—এমন আগাম সতর্কবার্তা দেওয়ার পরও অসাধু চক্রটির বেপরোয়া ভাব।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চিনির গুদামজাত পরিস্থিতি ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে তদারকি না করলে রিফাইনারি ও মিল মালিকরা সিন্ডিকেট তৈরি করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উৎপাদন কমিয়ে সংকট সৃষ্টি এবং অনৈতিক মুনাফা লাভের চেষ্টা করবেন। বাস্তবেও এখন তা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এ নিত্যপণ্যের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে পাঁচ টাকা পর্যন্ত। গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১৫ টাকা।
এ বিষয়ে ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আজিজুর রহমান গতকাল সোমবার বলেন, ‘সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা সব সময়ই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তারা জানে যে যতই মুনাফা করুক, সরকার তাদের কিছুই করতে পারবে না। তাই তারা এ অতি মুনাফা করে থাকে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি। এত যে দাম বাড়ানো হলো, কারা সিন্ডিকেট করল, কে অতি মুনাফা করল, কাউকেই তো ধরা হলো না। অপরাধ করলে, শাস্তি না হলে তো এমন অবস্থা চলতেই থাকবে। উচিত হলো যারা বলছে যে তাদের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ আছে, তা সরেজমিনে দেখা। প্রত্যেকের গুদামে হানা দেওয়া দরকার। তারা সত্য বলছে কি না যাচাই করা উচিত। পরে দেখা যাবে, বলবে মজুদ নেই। ততক্ষণে হাতিয়ে নেবে বিপুল অঙ্কের টাকা। সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর উচিত এখনই এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।’
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা ওত পেতে থাকে, সুযোগ পেলেই বাজার অস্থির করে তুলছে। রমজান মাসকে ঘিরে প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। এর আগেও ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটেছে; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বাজার আরো অস্থির হয়ে উঠতে পারে। রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণ দুরূহ হয়ে পড়তে পারে।’
ট্যারিফ কমিশন সূত্র জানায়, দেশের রিফাইনারিগুলোর চিনি উৎপাদনক্ষমতা সাড়ে ২৮ লাখ টন। আর বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) উৎপাদনক্ষমতা দুই লাখ ১৪ হাজার টন। সব মিলিয়ে চিনির উৎপাদন প্রায় ৩১ লাখ টন। বিপরীতে বাংলাদেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা সাড়ে ১৭ লাখ টন। অর্থাৎ উৎপাদনক্ষমতার ৬০ শতাংশ ব্যবহার করলেই চিনির চাহিদা পূরণ সম্ভব।
গেল ৯ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিনি উৎপাদক, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএসএফআইসি জানায়, তাদের কাছে উৎপাদিত চিনির মজুদ আছে ৫৩ হাজার টন। মৌসুম শেষে আরো ৯০ হাজার টন চিনি মজুদ হবে। এর বাইরে সংস্থাটি এক লাখ টন চিনি আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে। সময়মতো চলে আসবে ওই চিনিও।
বৈঠকে বিএসএফআইসির প্রতিনিধি জানান, আসন্ন রমজানে চিনির চাহিদা তিন লাখ টন। গেল জানুয়ারি পর্যন্ত বেসরকারি রিফাইনারিগুলো ১০ লাখ ৭৯ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছে। তাই সার্বিক বিবেচনায় রমজানে চিনিসংকটের কোনো কারণই নেই।
বৈঠকে দেশের অন্যতম শীর্ষ চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের প্রতিনিধি জানান, তাঁদের কাছে এক লাখ ২০ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি রয়েছে। আরো ৯১ হাজার টন বন্দরে রয়েছে খালাসের অপেক্ষায়। মেঘনা গ্রুপের প্রতিনিধি জানান, তাঁদের কাছেও এক লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আছে। আরো আড়াই লাখ টন চিনি খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে বন্দরে। অর্থাৎ বিএসএফআইসি, সিটি গ্রুপ আর মেঘনা গ্রুপের কাছে যে মজুদ ও খালাসের অপেক্ষায় চিনি রয়েছে, তার পরিমাণ প্রায় ছয় লাখ টনের মতো। সব রিফাইনারির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের কাছে অপরিশোধিত চিনি আমদানি ও মজুদের পরিমাণ সন্তোষজনক। রমজানে চিনির কোনো সংকটের আশঙ্কাই নেই। তবে তারা বিশ্ববাজারে দাম কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় বিদ্যমান শুল্ক-কর কমানোর দাবি করে। জবাবে শিল্প মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এখতিয়ারে থাকায় তাদের কোনো করণীয় নেই।
এদিকে এনবিআরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চিনিতে যে হারে শুল্ক আরোপ করা আছে, তা রাজস্ব আয়ের স্বার্থে যৌক্তিক হারেই আছে। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ে ঘাটতির কারণে এ শুল্কহার শিগগিরই কমানো হবে—এখনো তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তারা দেখছে না বলে জানায়।
এদিকে বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, পাইকারি বাজারে চিনির বাড়তি দামের কারণে খুচরা পর্যায়েও দাম বাড়ছে। চিনি আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে চিনির দাম বাড়তি। আর পণ্য আমদানিতেও উচ্চ শুল্কহার চিনির দাম বাড়িয়ে তুলতে ভূমিকা রাখছে। গত এক সপ্তাহের তুলনায় প্রতি টন চিনির দাম বেড়েছে ৩০ ডলার। এই দাম সমন্বয় করতে দেশের বাজারে চিনির দাম বাড়ছে।
এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেশি। আমদানিতেও উচ্চ কর। সব সমন্বয় করতে দাম কিছুটা বেড়েছে।’ রোজাকে ঘিরে দাম বাড়ানো হচ্ছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রোজার কারণে নয়, বিশ্ববাজারে দাম বাড়তির কারণে দাম কিছুটা বেড়েছে।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘রবিবার (গতকাল) প্রতি টন চিনি বিক্রি হয়েছে ৩৯০ ডলার, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৩৫০ থেকে ৩৭০ ডলার। এখন বাড়তি দাম কিভাবে সমন্বয় হবে? আবার রয়েছে সরকারের উচ্চ শুল্ক।’ বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার প্রভাব সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে স্থানীয় বাজারে পড়ে—এ প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো জবাব দিতে পারেননি।
খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম পড়ছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। কোথাও কোথাও ৬৫ টাকা দামেও চিনি বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি সাদা চিনি বিক্রি করছেন ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। তাঁদের মতে, এক সপ্তাহ আগেও এই দাম ছিল ৬২-৬৪ টাকা। দাম বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তত পাঁচজন ব্যবসায়ী কালের কণ্ঠকে জানান, মিলগেটে চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে। বাড়তি দামে চিনি কেনার কারণে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
টিসিবির তথ্যানুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনির দাম বেড়েছে ৮ শতাংশ। বছরের হিসাবে এই মূল্যবৃদ্ধি ২৮ শতাংশের বেশি। গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা আর গতকাল বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। সেই হিসাবে বছর ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১৫ টাকা।
বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন, ‘রমজান মাসকে ঘিরে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রতিটি মিলে পর্যাপ্ত চাপ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেশি থাকায় দেশীয় বাজারেও প্রভাব পড়ছে। আমদানির ক্ষেত্রেও রয়েছে উচ্চকর, যাতে কম দামে চিনি বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।’