বৈশ্বিক সংকটে জাতিসংঘের বাস্তবিক ভূমিকা

সাইফুল ইসলাম সাব্বির ।।
মানুষ সামাজিক জীব।আর প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন কিছু সুযোগ সুবিধা আর অধিকার।যেগুলোকে আমরা মানবাধিকার বলে থাকি।মানবাধিকার ছাড়া মানুষ পূর্ণাঙ্গ ভাবে বিকশিত হতে পারে না।

পৃথিবী নামক গ্রহটিতে গত ২০ শতকে দুটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়।এগুলো হলো প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।দুটি যুদ্ধেই মানবাধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েন,ধ্বংস হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। যার ফল আজও ভোগ করতে হচ্ছে ভুক্তভোগী দেশগুলোকে।

১৯১৪সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও ধ্বংসলীলা মানুষকে যুদ্ধের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও শান্তির জন্য আগ্রহী করে তোলে। যার ফলশ্রুতিতে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন তাঁর বিখ্যাত ১৪ দফা পেশ করেন।উইলসন তাঁর ১৪ দফার ১৪ নং দফায় বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংঘটন গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন।এর প্রেক্ষিতেই ১৯১৯ সালের ২৮ জুন ভার্সাই চুক্তির ফলস্বরূপ জাতিপুঞ্জ নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার আত্মপ্রকাশ ঘটে। যার মূল লক্ষ্য ছিলো বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।কিন্তু প্রতিষ্ঠান টি বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জনে ব্যর্থ হয়।ফলে ১৯৩৯ সালে শুরু হয় ২য় বিশ্ব যুদ্ধ,যা মানবসভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কিত ও বিভীষিকাময়।

এ যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্ব বিবেক কে নাড়া দেয় এবং আতঙ্কিত করে তোলে।যার ফলে বিশ্বের নেতৃত্বস্থানীয় দেশ গুলো এক জোট হয়ে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য আরেকটি নতুন আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।যার ফলশ্রুতিতে কয়েকটি সম্মেলনের মাধ্যমে ১৯৪৩ সালের ২৪ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মপ্রকাশ করেন জাতিসংঘ ।

বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা হলেও,একবিংশ শতাব্দীতে এসে জাতিসংঘ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে অনেকটাই ব্যর্থ।পৃথিবীর ক্রান্তিকালীন সময়েও জাতিসংঘ কে অনেকটা নীরব ভূমিকা করতে দেখা যায়।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমালোচনা ছাড়া কোনো কার্যকরী পদক্ষেপই গ্রহণ করতে পারছে না।ফলে লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার।

১৯৪৫-২০২০ এ দীর্ঘপথ অতিক্রম করেও জাতিসংঘ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হতে অনেকটাই দূরে।একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে নানাবিধ সমস্যা।আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ, ইরান আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধ, ধনী গরীব দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, মধ্যপ্রাচ্যের উগ্রপন্থী রাজনীতির বিকাশ,ফিলিস্তিন সিরিয়া সমস্যা,এবং সম্প্রতি রোহিঙ্গা সংকট ও কাশ্মীর ইস্যু এর কোনোটিতেই সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিসংঘের কোনো কার্যকরী ভূমিকা ছিলো না।জাতিসংঘের এই নীরবতা বৈশ্বিক সংকটে জাতিসংঘের ভূমিকাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

এইতো ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের অন্যায় ভাবে গণহত্যা চালানোর কারণে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া মিয়ানমার এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেন।কিন্তু মায়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ ই নেই নি জাতিসংঘ।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিশ্বদরবারে পেশ করলেও জাতিসংঘ আজও কোনো ভূমিকা পালন করেন নি, নিন্দা প্রস্তাব পাশ ব্যতীত। যা জাতিসংঘের চরম ভাবে ব্যর্থতা প্রকাশ পাচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ উন্নয়নশীল দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না।প্রতিবছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান নিজ নিজ দেশের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন এবং জাতিসংঘের কাছে সহায়তা করার আহবান জানা।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো শ্রবণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে।জাতিসংঘ তেমন কোনো কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে থাকেন না।

জাতিসংঘের এই নীরবতা শক্তিধর রাষ্ট্র গুলোকে আরো করে তুলছে আগ্রাসী।আজকের এই মধ্য প্রাচ্যের সংকট জাতিসংঘের নীরবতার কারণেই আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে।২০০১ সালে সন্ত্রাস বিরোধী অভিজানের নামে আমেরিকা আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলো,২০১১সালে গাদ্দাফিকে উৎখাত করার জন্য লিবিয়ায় মার্কিন বাহিনীর হামলা এবং সম্প্রতি ইরানের কাশেম সোলাইমান এর হত্যা এর সব কিছুর পিছনেই দায়ী জাতিসংঘের নীরবতা।একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ভিতর জাতিসংঘের অনুমতি ব্যাতিতো অন্য এক্টি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান এর নামে,তাতেও জাতিসংঘ কোনো কার্যকরী ভূমিকা পালণ করছে না।যা জাতিসংঘের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং গনতন্ত্রের রক্ষক বলে দাবী করে কিন্তু গঠনগতভাবে নিজেরাই গনতান্ত্রিক নাহ।
জাতিসংঘের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগটি হচ্ছে স্থায়ী পরিষদের পাঁচ সদস্য দেশের সীদ্ধানই হচ্ছে চূড়ান্ত সীদ্ধান্ত।যার ফলশ্রুতিতে তাদের স্বার্থবিরুধী কোনো সমস্যাই সমাধান হচ্ছে না।অস্থায়ী পরিষদের ১৫ সদস্য থাকলেও তাদের কোনো ভূমিকায় নেই।যার ফলে অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে রোহিঙ্গা, কাশ্মীর ইস্যু,মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের মত বড় বড় সমস্যা গুলো।

জাতিসংঘের আরেকটি বড় ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধকল্পে ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কপ-২১সম্মেলনে গৃহীত জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়ন করতে না পারা।এর প্রধান কারণ ছিলো চুক্তিটি শিল্পউন্নত দেশগুলোর স্বার্থ বিরোধী ছিলো।আমেরিকা প্রথমে চুক্তির পক্ষে সই করলেও পরবর্তীতে নিজেদের নাম প্রত্যাখ্যান করেন।জাতিসংঘের এই পক্ষপাত মূলক আচরণ জাতিসংঘের নিজ জায়গা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাকালে যে বৈষম্য (স্থায়ী পাঁচ সদস্যর ভেটো দান শক্তি)সৃষ্টি করা হয়েছিলো, সে বৈষম্য আজও বিদ্যমান।যার ফলে জাতিসংঘের মূল লক্ষ্য “বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা” অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে।এ বৈষম্য যদি বিদ্যমান থাকে তাহলে পৃথিবী যুদ্ধ নামক ধ্বংস লীলা থেকে কখনোই মুক্তি পাবে না।হয়তো জাতিসংঘের মূল স্লোগান “ইটস ইউর ওয়ার্ড” পরিবর্তিত হয়ে পরোক্ষভাবে রূপ নিবে “ইটস আওয়ার(ভেটোদান কারী পাঁচ স্থায়ী সদস্য)ওয়ার্ল্ড”!

লেখক:

শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, স্নাতক (সম্মান), আইন বিভাগ,

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

     আরো পড়ুন....

পুরাতন খবরঃ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  
error: ধন্যবাদ!