স্বকৃত গালিব :
আসাম মিজোরাম সীমানা বিরোধ বেশ কয়েক দশক পুরনো। গেল বছর এখানে কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে এবং এ বছর ঘটনাটি চূড়ান্ত রূপ নেয় ।১০ জুলাই কিছু ঘটনা ঘটে এবং ১১ জুলাই ও কিছু ঘটনা ঘটে ।অবশেষে চুড়ান্ত ঘটনা ঘটে যায় ২৬ জুলাই।
মিজোরামের হামলায় সীমান্ত অগ্নিগর্ভ হয় আসামের লায়লাপুর। গুলির লড়াই চলে সেখানে। প্রাণ হারায় আসাম পুলিশের ৫ সদস্য। মিজোরাম পুলিশ দফায় দফায় গুলি চালায় আসাম পুলিশের উপর ।
এ ঘটনায় আসাম পুলিশ দাবি করে তাদের অন্তত ৭০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। এসব আহত পুলিশ সদস্যদের শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ।
মিজোরামের পুলিশের অতর্কিত হামলায় অন্তত ২০ জন স্থানীয় নাগরিক আহত হয়েছে।এমনকি আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার পুলিশ সুপার বৈভব চন্দ্রকান্ত নিম্বালকর এবং ধলায় থানার ওসি সিহাবউদ্দিন বারভুঁয়াও গুরুত্ আহত হয়।
ঘটনাটি সংবাদ প্রকাশের পর পর সারা আসাম জুড়ে নিন্দর ঝড় ওঠে।লায়লাপুরের পরিস্তিতি দেখার জন্য আসামের মুখ্যন্ত্রী হেমন্তবিশ্ব শমা শিলচর আসেন।ঘটনার দিন রাতে পুলিশের জিডিপি ভাস্করজ্যোতি শিলচর আসেন।এতেই বুঝা যায় এবার মিজোদের ছাড় দিবে না আসাম ।
এবার দেখা যাক কেন এই বিবাদ?সীমানা বিবাদতো দুই পার্শ্ববর্তী দেশের মধ্যে হয়।কিন্তু একই দেশের দুই পার্শ্ববর্তী রাজ্যের মধ্যে বিবাদ ইতিহাসে বিরল| আসলে আসাম মিজোরাম বিরোধ অনেক পুরনো। আসামের মানচিত্র হল টি-শেপের।আসামের সীমা উত্তর-পূর্বেও ছয় রাজ্য এবং পশ্চিম বঙ্গের সাথেও তাদের সিমানা বিরোধ আছে।শুধু মাত্র সিকিমের সাথে আসামের কোন সীমানা বিরোধ নেই|
আসাম ও মিজোরামের মধ্যে সীমানা হল ১৬৪.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ।প্রায় একশত বছর আগে আসাম মিজোরাম সহ পুরো উত্তরপূর্ব ভারতই ছিল ব্রিটিসদের অধিনে।১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন যখন বঙ্গভঙ্গ ভাগ করেন,তখন এই পরো এলাকাটি পূর্ববঙ্গে চলে আসে।আর আসাম তখন নাগাল্যান্ড,অরুণাচল, মিজোরাম,মেঘারয় সহ রাজ্য নিয়ে তখনকার আসাম রাজ্য হয়।এবং একই রাজ্যের জেলাগুলো তখন সঠিক সীমানাও ছিল না,তাই বর্ডার ডিমার্কেশন সম্ভব ছিল না।আজকের মিজোরামকে সে ময়ম লুসাই হিলস বলা হত। ভারত স্বাধীনের পর ১৯৪৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিজোরাম আসামেরই অঙ্গ ছিল।১৯৭১ সালে মিজোরামকে ভারতের কেন্দ্রশাসিক অঞ্চল করা হয়।এরপর ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৩ তম Constitutional Amenment Act,১৯৮৬-র দ্বারা মিজোরামকে আলাদা রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়।তখন থেকেই আসামের সাথে মিজোরামের সিমান্ত সমস্যা শুরু হয়।মিজোরামের তিন জেলা আইজল,কালাশিব ও মামিত এবং আসামের বরাক উপত্যকার তিন জেলা কাছাড়,করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দির সাথে সিমানা বানায়।মিজোরামের কথা হল আসাম-মিজোরামের সিমানার সব কিছু মানা উচিৎ,যা ১৮৮৫-র নোটিফিকেশনে বলা হয়েছিল এবং যা নেওয়া হয়েছিল বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার নোটিফিকেশন (BEFR) অ্যাক্ট,১৮৭৩ থেকে। এই নোটিফিকেশন লুসাই হিলস ও কাছার প্লেইনের মধ্যের সিমানা করা হয়।
মিজোরাম এই নোটিফিকেশন মানতে চায় কারণ মিজোরাম এই নোটিফিকেশনে কিছু বেশি জায়গা পেয়ে যায়।এবার আসামের কথা হল ১৯৩৩ সালে ডিমার্কেশন করা হয়েছিল তা মানা উচিৎ।কারণ ওই সালের নোটিফিকেশনে লুসাই হিলসের সঙ্গে সিমানা তৈরী হয়।
কিন্তু মিজোরামের কথা হল ১৯৩৩ সালের ডিমার্কেশনে মিজো সোসাইটির মতামত নেওয়া হয়নি।কিন্তু তারা এটা বুঝতে চাচ্ছে না যে,তারা ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আসামেরই অংশ ছিল।এবার এই যে,বিবাদ শুরু হয়ে গেল,তার সমাধানের জন্য ১৯৯৫ সালে প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হয়।কিন্তু সেই পদক্ষেপ খুব একটা কাজে আসেনি।যদিও আসাম ও মিজোরাম একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নেয় যে,মিজোরামের কালাশিব ও আসামের হাইলাকান্দিতে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হবে।যার মাধ্যমে অন্য সব গতিবিধির দিতে লক্ষ্য রাখা হবে এবং দুই রাজ্যের মানুষই এই অঞ্চলে যেন কোনও জমি দখল করতে না পারে ও জোরজোবরদস্তি না করতে পারে।
এক কথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে,যতদিন পর্যন্ত আসাম-মিজোরাম সিমান্ত বিবাদ পুরোপুরি না মিটে যায়,তত দিন পর্যন্ত এই ১০-১২ কিলোমিটার অঞ্চলে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের লোক থাকবে।কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকে আসাম-মিজোরাম সিমানা বিবাদ কখনো শেষ হয় না।মিজোরামের অনেক মানুষ এই এলাকাতে এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে।এর জেরে মাঝে মাঝে দুই রাজ্যের পুলিশ এত জড়িয়ে পড়ে।তখন এই বিবাদ চুড়ান্ত আকার ধারণ করে।এই বছরের জুন থেকে মিজোরামের মানুষরা আসামের এই অঞ্চলের ১০ কিরোমিটার ভিতরে প্রবেশ করে।আবার মিজোরাম বলছে আসামের মানুষরা তাদের অঞ্চলের ২.৫ কিলোমিটার ভিতরে প্রবেশ করেছে।
এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অজয়কুমার ভাল্লা আসাম ও মিজোরামের মুখ্যসচিব এবং ডিজিপিকে দিল্লিতে ডেকে পাঠায়।আসামের মুখ্য সচিব বলেন,করোনা পূর্ব অর্থাৎ গত বছরের এপ্রিল মাসে যে,স্থিতি ছিল দুই রাজ্যের পুলিশ সবাই সেখানে চলে যাবে।মিজোরামের সরকার মাধ্যমে জানানো হয় যে,এ ব্যাপারে সমাধানের জন্য দুই রাজ্যের সর্বময় কর্তারা বিষয়টা দেখছেন।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্তবিশ্ব শর্মা দাবি করেন,স্যাটেলাইট ম্যাপিং-র এই সিমান্ত সমাধান করা হোক।কিন্তু তা কতটুকু যুক্তি সঙ্গত,এ নিয়ে সন্দেহ আছে।আর এই হল আসাম-মিজোরাম সিমান্ত বিরোধের মূল কারন।সব শেষ এর জেরে মিজোরাম-আসামের ৫ পুরিশকে গুলি করে হত্য করে এবং ৭০ জন পুলিশকে আহত করে।এর সমাধান কবে হবে তার জানা নেই।কিন্তু এই সমস্যার সমাধান যে সম্ভব নয়,এরকম কোন কথা মেনে নেওয়া যায় না।বাংলাদেশ-ভারত সিটমহল বিবাদ,ভারত-পাকিস্থান কাশ্মীরের সিমানা বিবাদ যদি সমাধান হতে পারে তবে আসাম মিজোরাম সিমানা বিবাদ খুব সামান্য বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে।কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এই সমস্যা সহজেই সমাধান করা সম্ভব,কারণ বিজিপি সরকারী দল,অন্যদিকে আসামে বিজিপির হেমন্তবিশ্ব শর্মা ও মিজোরারে বিজিপির জোট সরকার ক্ষমতায়।এই সমস্যা সমাধানের এখই মুখ্য সময়।আর সবাই যদি ভোটের সমিকরণের জন্য এই সমস্যা জিইয়ে রাখে তাহলে আসাম-মিজোরাম সিমান্ত ভারত-পাকিস্থান বা ভারত-চীন সিমান্তে পরিনতি হবে।এবং আসাম পুলিশের মতন আরো পুরিশ সদস্য শহীদ হবে।আর সময়ই বলে দিবে আসাম-মিজোরাম সিমান্তের ভবিষ্যত কি?
লেখক: শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর , আইন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়,সদস্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমতি (কুবিসাস)।