জেলা প্রতিনিধি, নেত্রকোনা :
কাদম্বরী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই’- কবিগুরুর ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের বহুল শ্রুত এ উক্তি যেন সত্যি হয়ে ফিরে এলো তাদের জীবনে। যারা সত্যি সত্যি জীবিত থেকেও কাগজে-কলমে মৃত চিহ্নিত হয়েছেন। ভোটার আইডি কার্ডের তালিকায় মৃতের সারিতে রাখা হয়েছে তাদের নাম।
যে কারণে ব্যাংক লোন, জমি কেনাবেচা, সন্তানদের লেখাপড়া-চাকরি থেকে শুরু করে সরকারের ১০ টাকা কেজির চালসহ বয়স্ক ও বিধবা ভাতাও জুটছে না তাদের। নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বারইকান্দি গ্রামের এমনই একাধিক বাসিন্দা জানেন না এ বিড়ম্বনার কারণ। ওই এলাকায় মৃতের তালিকায় এমন শখানেক ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের খোঁজ মিলেছে। যারা নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে চান। তবে গল্পের অভিমানী কাদম্বরীর মতো মরে নয়, জীবিত থেকে।
সরেজমিনে সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ওই গ্রামের একজনের নাম জামাল মিয়া (৪৫)। গ্রামে ছোটখাটো ব্যবসা করেন। গত ১০ বছর ধরে জাতীয় পরিচয়পত্রে তিনি মৃত। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের আবেদন করেও কাগজে-কলমে মৃত চিহ্নিত হওয়ায় ঋণ পাচ্ছেন না তিনি।
গ্রামের একটি স্কুলে পড়াশোনা করে জামাল মিয়ার সন্তান। স্কুলের ভর্তি কিংবা রেজিস্ট্রেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজেও তার আইডি কার্ড ফিরিয়ে দিয়েছেন শিক্ষক। বাধ্য হয়ে স্ত্রীর আইডি কার্ড দিয়ে সন্তানের নাম রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়েছে।
জামাল মিয়ার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে থাকেন ইদ্রিস আলী (৫৪)। তার দুই কন্যা ঢাকায় পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য দীর্ঘদিন ধরে আবেদন করছেন। চাকরির ইন্টারভিউতে বাবার আইডি কার্ড স্থাপন করতে গিয়ে পড়েন বিড়ম্বনায়। বাবা জীবিত অথচ আইডি কার্ডে লেখা রয়েছে মৃত।
একই গ্রামের বাসিন্দা সুবহান মিয়া। নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে বারবার উপজেলা নির্বাচন অফিসে কাগজপত্র নিয়ে দৌড়ঝাপ করতে করতে এখন কাগজগুলোই হারিয়ে ফেলেছেন। ২০০৯ সালে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমের সময় পাশের গ্রামে একই নামের আরেক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর শুনে মৃতদের তালিকায় ঢুকে যায় তার নাম। এরপর থেকেই শুরু হয় তার ভোগান্তি। বাড়িতে ঘর তৈরি করতে জমি বিক্রি করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকছেন ভাঙা ঘরে।
আরেক বাসিন্দা আছিয়া খাতুন (৫৫) বেঁচে থেকেও জাতীয় পরিচয়পত্রে মৃত চিহ্নিত হওয়ায় গত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। তার স্বামী মারা গেছেন অনেক আগে। বারবার জনপ্রতিনিধিদের কাছে গিয়েও পাননি একটি বয়স্কভাতার কার্ড। কারণ, তিনিও যে কাগজপত্রে মৃত! এ কারণে করোনাকালীন সরকারের প্রণোদনা হিসেবে ১০ টাকা কেজি দরের চালও জোটেনি তার ভাগ্যে।
‘জীবিত থেকেও মৃত’ এ গ্রামবাসীদের অভিযোগ, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের সময় তথ্য সংগ্রহকারীরা সঠিকভাবে তথ্য যাচাই করেননি। তথ্য সংগ্রহ করার সময় তাদের কারও বাড়িতে যাননি তথ্য সংগ্রহকারী স্থানীয় শিক্ষকেরা। মনগড়া তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হালনাগাদ করা হয়েছে। ২৭৮.২৮ বর্গ কিলোমিটারের দুর্গাপুর উপজেলায় মোট জনসংখ্যা দুই লাখ ২৪ হাজার ৮৯৩ জন। আর ওই উপজেলায় স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে এক লাখ ৫১ হাজার ৪১৮ জনকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জীবিত থেকেও মৃতদের তালিকায় নাম রয়েছে অন্তত একশো জনের। এ ছাড়া দ্বৈত ভোটারও রয়েছেন আরও আটশোর বেশি লোক। নাম সংশোধনের পাশাপাশি এ ধরনের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করার জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন সুবিধাবঞ্চিতরা।
এ বিষয়ে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ফারহানা শিরিন বলেন, তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় মৃত ব্যক্তিদের নাম কর্তন করে নিয়ে আসেন। ওই সময় দেখা যায়, কিছু ভুল তথ্যের কারণে জীবিত ব্যক্তিদের নাম মৃতদের তালিকায় চলে যায়।
এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন অফিসে এসে নতুন করে আবেদন করলেই আমরা তাদের আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে সমস্যাগুলো আইডেন্টিফাই শেষে পাঠিয়ে দিই। নাম সংশোধনের ক্ষেত্রে বিধি মোতাবেক আবেদন করলে যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।