টাউন হল ছাড়া কুমিল্লা, কুমিল্লাই নয়!

প্রভাষ আমিন : সবার কাছেই তার নিজের শহরই সবচেয়ে প্রিয়। আমার জন্ম গ্রামে। তাই সে অর্থে আমার নিজের কোনো শহর নেই। ৩০ বছর ধরে ঢাকায় ভাসমান আছি। কিন্তু ঢাকাকে কখনো আমার নিজের শহর মনে হয়নি। ৩০ বছরে ১৬টি মেস বা বাসায় থেকেছি। ঢাকায় তো আমি ভাসমানই। আমার ৫২ বছরের জীবনের বছর তিনেক কেটেছে কুমিল্লায়। তাও থেকেছি ভিক্টোরিয়া কলেজের হোস্টেলে, মানে নিউ হোস্টেলে। নামে নিউ হলেও হোস্টেলটির পুরনো তিনটি ভবনই এখন বিধ্বস্ত, পরিত্যক্ত। ছেড়ে আসার ৩২ বছর পর গত ফেব্রুয়ারিতে নিউ হোস্টেলে গিয়েছিলাম। হোস্টেলের ভগ্নদশা দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি নিউ হোস্টেলের পুকুরটি দেখে। আমার দেখা সবচেয়ে স্বচ্ছ পানির পুকুরটিও এখন পরিত্যক্তপ্রায়। মাছ-টাছ চাষ হয়, কিন্তু গোসলের পরিবেশ নেই।

ভবনগুলো না হয় সময়ের কারণে ধসে পড়েছে, পুকুর তো তা নয়; পুকুরটিকে তো আমরা হাতে ধরে নষ্ট করেছি। বলছিলাম নিজের শহরের কথা। বছর তিনেক থাকলেও কীভাবে যেন কুমিল্লা আমার শহর হয়ে গেছে। কুমিল্লায়ও আমার কোনো ঠিকানা নেই, তবু কুমিল্লাই আমার শহর, প্রাণের শহর। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু, পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছু পিছু…।’ কুমিল্লার সেই বছর তিনেকের সময় আমার জীবনের সোনালি অধ্যায়। মিছিল-মিটিং, আন্দোলন, পুলিশের সঙ্গে মারামারি, হলে হলে সিনেমা দেখা, রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে গলিতে ঘোরা- আহা! আমার প্রাণের কুমিল্লা।

আসলে কুমিল্লা অদ্ভুত একটা মায়ার শহর। কিছুদিন থাকলেই ভালো না বেসে পারা যায় না। কুমিল্লাকে বলা হতো ব্যাংকের শহর, ট্যাংকের শহর। কুমিল্লা ছিল শান্ত, ছায়া-সুনিবিড়, ছায়াঢাকা, পাখি ডাকা। ছিল লিখেছি, কারণ সেই কুমিল্লা আর নেই। ৩২ বছরে কুমিল্লা অনেক বদলে গেছে। আমি যখন কুমিল্লা ছেড়ে আসি, তখন সেখানে একটি মাত্র হাসপাতাল ছিল- সদর হাসপাতাল। এখন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ তো আছেই; কুমিল্লা যেন এখন ক্লিনিকের শহর। গত কয়েক বছরে অনেক ট্যাংক মানে জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। ব্যাংক-সমবায়ের সেই ঐতিহ্যও আর নেই। কুমিল্লার যেদিকে চোখ যায়, আকাশ ঢেকে দেওয়া সুউচ্চ ভবন। উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে ঐতিহ্যের কুমিল্লা। আড়ালে-আবডালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভবন ভাঙা পড়েছে। বছর চারেক আগে শহরের প্রাণকেন্দ্রে পূবালী ব্যাংক ভবন ভাঙা শুরু হয়েছিল। তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেটা ঠেকানো গেছে। এবার লোভের ভয়াল থাবা কেড়ে নিতে চাইছে কুমিল্লার প্রাণ টাউন হল।

সব টেলিভিশন স্টেশনেই দেশের বিভিন্ন এলাকার জিভি আছে, জিভি মানে জেনারেল ভিউ। এমন ছবি যাতে চট করে সেই এলাকাটা চেনা যায়। সব টিভিতে কুমিল্লার জিভি মানেই টাউন হল। এ টাউন হলই হলো কুমিল্লার রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র। ১৮৮৫ সালে ত্রিপুরার মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে ১০ বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করেন অনন্য স্থাপত্যশৈলীর এ টাউন হল। তাঁর নামেই এর নামকরণ- ‘বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন’, যা পরিচিতি টাউন হল নামে। অন্তত ৩০ হাজার বইয়ের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা রয়েছে এ লাইব্রেরির।

কুমিল্লায় থাকার সময় আমি প্রায় নিয়মিত সে লাইব্রেরিতে যেতাম। শুধু লাইব্রেরি নয়, দোতলা মিলনায়তনটি সব সময় মুখরিত থাকে নানান কর্মকান্ডে। টাউন হলের সামনের গোলচত্বরের স্মৃতিসৌধে রয়েছে কুমিল্লার প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা। টাউন হল ময়দানেই সব বড় রাজনৈতিক সমাবেশ হয়। এ ময়দানেই আছে কুমিল্লার শহীদ মিনার। কুমিল্লা টাউন হল নিছক ১৩৫ বছরের পুরনো একটি ভবন নয়। টাউন হল ইতিহাসের হাজার পৃষ্ঠা যেন। মহাত্মা গান্ধী, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নবাব স্যার সলিমুল্লাহসহ বিখ্যাত মানুষের স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ টাউন হল, যেটি ভেঙে আধুনিক মিলনায়তন, লাইব্রেরি গড়ার পরিকল্পনা এখন পাক্কা।

ঐতিহ্যের ধারক সেই টাউন হল ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রস্তাবিত বহুতল ভবনে পাঠাগার, একাধিক মিলনায়তন, মহড়াকক্ষ, ভিআইপি লাউঞ্জ, অতিথি কক্ষ, দোতলা গাড়ি পার্কিং, প্রবেশ ও বাইরের আলাদা সড়ক, ক্যান্টিনসহ নানা ধরনের কক্ষ থাকবে। গত ২ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় বহুতল ভবনের নকশার ডিজিটাল অ্যানিমেশন উপস্থাপন করা হয়। দেখে আমারই মন ভালো হয়ে গেছে। কুমিল্লায় এমন একটি আধুনিক ভবন হবে ভাবতেই ভালো লাগছে। কিন্তু সেটি টাউন হল ভেঙে করতে হবে কেন? সে বৈঠকে টাউন হলকে হত্যার রোডম্যাপ চূড়ান্ত হয়ে গেছে। প্রথমে জেলা প্রশাসক টাউন হলকে বিপজ্জনক হিসেবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করবেন। তারপর ২ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে উপস্থিত জনাবিশেক মানুষের মতামতকে টাউন হলের ব্যাপারে কুমিল্লাবাসীর মতামত হিসেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত পেলেই ধুলায় মিশে যাবে ১৩৫ বছরের ঐতিহ্য, আকাশ ছোঁবে উন্নয়ন।

টাউন হল নাকি এখন কুমিল্লার উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা। কুমিল্লার এত শত উন্নয়ন নাকি লজ্জায় মুখ ঢাকে ১৩৫ বছরের বুড়ি টাউন হল দেখে। টাউন হল হলো সন্তানের আধুনিক ফ্ল্যাটে বেখাপ্পা, আনস্মার্ট বুড়ি মায়ের মতো। মাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া আর টাউন হল ভাঙার পরিকল্পনাটা আমার কাছে একই রকম মনে হয়েছে। মালয়েশিয়ায় পুত্রাজায়ার মতো একদম আনকোরা শহর যেমন আছে, তেমনি আছে শত বছরের ঐতিহ্য ধারণ করা মালাক্কাও। আপনি নতুন একটি শহর বানাতে পারবেন, কিন্তু ঐতিহ্য বানাতে পারবেন না। আপনি টাকা দিয়ে এক শ তলা ভবন বানাতে পারবেন, আরেকটা কুমিল্লা টাউন হল বানাতে পারবেন না।

বয়স আর ঝুঁকিই যদি কোনো ভবন ভাঙার একমাত্র মাপকাঠি হয়, তাহলে কুমিল্লা কেন বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অনেক ভবন এখনই ভেঙে ফেলতে হবে। এ এক অদ্ভুত আত্মহনন-প্রবণতা। ঐতিহ্যকে যারা রক্ষা করতে পারে না, তারা বড় দুর্ভাগা। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে- আমরা ঐতিহ্যকে দুমড়ে-মুচড়ে তার ওপর আকাশছোঁয়া ভবন বানাব, নাকি ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে, তার পাশে নতুন ভবন বানাব। এমনিতেই কুমিল্লা একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। একসময় অবিভক্ত ভারতের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ছিল কুমিল্লা। এ শহরের রাস্তায় হাঁটতে গেলেই আমি শিহরিত হই। এখানে নজরুল হাঁটতেন। এখানে বসে নজরুল কবিতা লিখতেন। আড্ডা মারতেন। এই বুঝি বাতাসে ভেসে এলো শচীনকর্তার নাকিকণ্ঠ ‘তোরা কে যাসরে…’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে কুমিল্লা। বুদ্ধদেব বসুর জন্ম কুমিল্লায়। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁদের সেতার ঝঙ্কার তুলেছে কুমিল্লার বাতাসে। পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথম বাংলা ভাষার দাবি তুলে ধরা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কুমিল্লার সন্তান।

গর্বে আমার বুক ফুলে যায়। কুমিল্লার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল নজরুলের অনেক স্মৃতি। আজ তার কিছুই নেই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, অস্তিত্ব নেই নজরুলের শ্বশুরবাড়িরও। শচীন দেববর্মণের যে বাড়িতে নজরুল আর শচীন গানের আসর বসাতেন, দীর্ঘদিন সেটি মুরগির খামার হয়ে ছিল। নজরুল-শচীনের স্মৃতিধন্য বাড়িতে মুরগির খামার! এ যে কত বড় পাপ, তা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে আমাদের। অনেক চিৎকার-চেঁচামেচির পর শচীনকর্তার বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত। কাউকে কিচ্ছু করতে হবে না, কয়েক বছর পর এমনিতেই, যে বাড়ি থেকে একাত্তরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সে বাড়িটি মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। হায়! আমরা কতই না অকৃতজ্ঞ।

ভাষাসংগ্রামের অগ্রসেনানী, একাত্তরে যিনি জীবন দিয়েছেন; সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আমরা কুমিল্লার সাইনবোর্ড বানাতে পারতাম; তাঁকেই কিনা আমরা ভুলে বসে আছি অবলীলায়! তাঁর স্মৃতিকে ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছি। আসলে তো ধুলায় মেশাচ্ছি আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার। টাইন হল ভেঙে ফেলার মতো একটি সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের কারও বুক একটুও কাঁপল না! আমরা বোকা, নাকি অতিচালাক? এ সিদ্ধান্ত শোনার পর আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। অধিকাংশই এর বিপক্ষে। কিন্তু কুমিল্লায় বসে কেউই এর প্রতিবাদ করতে পারবেন না। সে সাহস তাদের নেই। কুমিল্লায় থাকলে হয়তো আমিও পারতাম না। কিন্তু কুমিল্লা টাউন হল শুধু কুমিল্লার ঐতিহ্য নয়, বাংলাদেশের ঐতিহ্য। তাই টাউন হল ভাঙার প্রতিবাদ করতে হবে সবাইকে।

কেউ ভাববেন না আমি প্রগতি, উন্নতি, আধুনিকতা, সমৃদ্ধিকে দূরে ঠেলে; ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে চাই। ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করেই তার পাশে আধুনিক শহর গড়ে তোলা সম্ভব। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেল দিতে পারাটাই মুনশিয়ানা। ভেঙে ফেলা নয়, টাউন হল হতে পারে কুমিল্লায় পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। সন্ধ্যার পর টাউন হলে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোর মাধ্যমে তুলে ধরা যেতে পারে কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্য। ঐতিহ্যকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। অতীত ভুলে, ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে কোনো দেশ, কোনো জাতি, কোনো শহর এগোতে পারে না। এখন কুমিল্লায় গেলে চোখ জুড়িয়ে যায়। শহরজুড়ে ব্যস্ততা, যানজট, বড় বড় মার্কেট, উঁচু উঁচু ভবন। উন্নতি দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু এসবের সঙ্গে আমি ফিরে পেতে চাই শান্ত, স্নিগ্ধ প্রাণের শহর, গানের শহর, শিল্পের শহর, ব্যাংকের শহর, ট্যাংকের শহর কুমিল্লাকে। এ টাউন হল, রানীর কুঠি, ধর্মসাগর, ভিক্টোরিয়া কলেজ, ঈশ্বর পাঠশালা, বার্ড আছে বলেই কুমিল্লা অনন্য। সব পুরনো ভবন ভেঙে নতুন করে বানালে সেটা কোনোভাবেই কুমিল্লা হবে না।

টাউন হল ছাড়া কুমিল্লা, আমার কাছে কুমিল্লাই নয়।

লেখক : সাংবাদিক।

     আরো পড়ুন....

পুরাতন খবরঃ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
error: ধন্যবাদ!